গোপা মুখার্জি, বিশেষ প্রতিবেদন: চিন্তন নিউজ:২৫/০৫/২০২৪:- বাংলার সাহিত্যাকাশে রবীন্দ্রপ্রতিভা যখন মধ্যাহ্ন- সূর্যের ন্যায় জাজ্জ্বল্যমান…..সেই সময়ে রবির খরতাপে দগ্ধ না হয়ে বিদ্রোহের বজ্র নিনাদে যিনি ঘোষণা করেছিলেন তাঁর আগমন বার্তা…..পরাধীন ভারতবর্ষের গ্লানি আগুন ঝরিয়েছিল যাঁর কলমে …….যাঁর গানে ও কবিতায় ধ্বনিত হয়েছিল নিপীড়িত মানবাত্মার অনুরণন……..তিনিই হলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি।একাধারে ছিলেন কবি,গল্পকার, সাহিত্যকার, সঙ্গীত রচয়িতাকার, সুরকার, নির্ভীক দেশপ্রেমিক, একনিষ্ঠ সাংবাদিক এবং সবার উপরে ছিলেন একজন ‘মানবতার কবি’। সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে মানুষের মধ্যে যে শ্রেণি বিভাজন………হিন্দু-মুসলমান-খ্রীষ্টান,রাজা-প্রজা,ধনী-দরিদ্র……এ সব শ্রেণি বিভাজন কে তিনি দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করেছেন, সকল মানুষের অধিকার ও সম্ভাবনার দিকে জোর দিয়েছেন। একদিকে যেমন শ্রমিক,কৃষক, সাধারণ মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন, অপরদিকে তেমনি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শকেও তুলে ধরেছেন। মানুষের চিরন্তন যে আশা- আকাঙ্খা, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, বীরধর্ম প্রভৃতি নিয়ে লিখেছেন অজস্র কবিতা। তাই তিনি ‘ মানুষের কবি’ নামে আখ্যায়িত।
আমাদের দেশের একটি অন্যতম প্রধান দোষ হচ্ছে সামাজিক বা কুলমর্যাদার মিথ্যা অহংকার। কবি এই ভেদাভেদের উর্ধে গিয়ে ‘যুগবানী’পত্রিকায় লিখলেন……..
‘সমাজ বা জন্ম লইয়া যে বিশ্রী উঁচুনীচু ভাব ,তাহা আমাদিগকে জোর করিয়া ভাঙিয়া দিতে হইবে।আমরা মানুষের বিচার করিব মনুষ্যত্বের দিক দিয়া, পুরুষকারের দিক দিয়া। ‘……এখানে মনুষ্যত্বের অর্থ মানবপ্রীতি এবং পুরুষকারের অর্থ বীরধর্ম। প্রেমের কোমলতা ও বীরত্বের দৃঢ়তা …..এই দুইয়ের মেলবন্ধন ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। পুরাণ-কোরান-গীতা-মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবী- ফারসী- সংস্কৃত- বাংলার শব্দ ভান্ডারের দুর্লভ চাবিকাঠি ছিল তাঁর হাতে। আর ছিল উদাত্ত কন্ঠ এবং বাংলার কীর্তন- বাউল- ঝুমুর- সারি- ভাটিয়ালির প্রতি প্রাণের টান ও সেই সঙ্গে ফারসী গজলের মন মাতানো সুর বাহার। বন্ধন-লাজ-ভয় জয় করবার সাধনা যারা করেছিলেন সেই বীরদের গান নজরুল গেয়েছেন…..
‘ গাহি তাহাদের গান
বিশ্বের সাথে জীবনের পথে যারা আজি আগুয়ান। ‘
নজরুল নিজের জীবনে যে বর্তমান কে পেয়েছিলেন তার থেকে উন্নততর বর্তমান গড়তে তিনি সদাই ছিলেন প্রয়াসী। মানবতার কল্যাণ-রথ সর্বদা ছুটিয়ে নিয়ে গেছেন সামনের দিকে,বলেছেন…….’ পেছনে তাকিয়ে হা- হুতাশ করে লাভ নেই। ‘ মানুষ যতদিন অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকে ,ততদিন সে নিজেকে চিনতে পারে না,সন্ধান পায়না নিজের শক্তির। কবি তাই বললেন…….
আমি সহসা আমারে চিনিয়া ফেলেছি
আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’
কবির বিদ্রোহ যেমন পরাধীনতার বিরুদ্ধে তেমনি তাঁর বিদ্রোহ সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধেও।তাঁর দৃষ্টিতে সমস্ত ভেদাভেদই মিথ্যা…….তা সে জাতিগত বৈষম্যই হোক,নারীপুরুষে ভেদাভেদই হোক বা ধনী-দরিদ্রে অসাম্য ,নয়তো বা মালিক-শ্রমিকের অসাম্য……..এই সব কিছু অসাম্য দূর করার দাবি করেছেন তিনি তাঁর ‘ সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছের বিভিন্ন কবিতায়।তিনি বলেছেন……….
‘ ও কি চন্ডাল! চমকাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব
ওই হতে পারে হরিশ্চন্দ্র ওই শ্মশানে শিব।’
সামাজিক জড়তা ও নৈষ্কর্ম্যের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী যেন দুরন্ত কালবৈশাখী।
দেশে একদিকে পরাধীনতার আন্দোলন, অপরদিকে বিদেশীর চক্রান্তে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে হিন্দু মুসলমান সমস্যা।কবির কন্ঠে ধ্বনিত হোল………
‘ হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার’।
নজরুলের কাব্য তাই হিন্দু মুসলমানের মিলনতীর্থ। সাম্রাজ্যবাদীর পেষণচক্রতলে নিষ্পিষ্ট মানবাত্মার ক্রন্দন ধ্বনি তিনি শুনেছেন। তাই ব্যাথাহত কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন……
‘ বন্ধু গো আর বলিতে পারি না বড় বিষ জ্বালা এই বুকে
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি তাই যাহা আসে কই মুখে
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা….’
নজরুল সেই রক্ত লেখার কবি।ব্যথিত মানবাত্মার কবি।
ভাবতে অবাক লাগে …..অসাম্প্রদায়িক, স্বচ্ছ মানবতাবাদে মুখর কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের সৃষ্টিসুখের উল্লাসমুখর সময়ের ব্যাপ্তি মাত্র বাইশ বছর। দুরারোগ্য ব্যাধি কেড়ে নিল তাঁর অমৃত-নির্ঝর কন্ঠ। নিদারুণ আর্থিক সংকট এবং সময়মতো চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর স্তম্ভিত, মুক,বধির হয়ে রইলেন তিনি।হয়তো বা যারা শুধু নিলে ,দিলে না কিছুই…….তাদের প্রতি ছিল তাঁর নীরব অভিমান।