মল্লিকা গাঙ্গুলী, চিন্তন নিউজ, ১৩ জুন: পেরু- ল্যাটিন আমেরিকার একটি ছোট্ট দেশ। সেই পেরু আজ বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার মূলকেন্দ্র। প্রায় তিন দশক ধরে চিলির মতোই ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশটি নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির দূর্গ হিসেবেই পরিচিত। আশির দশকে পেরুতে অতিবাম সশস্ত্র আন্দোলনের সমর্থক “শাইনিং পাথ” নামক উগ্র বামপন্থীদের শাসন এবং রাষ্ট্র শক্তির চরম দমন পীড়নে বিধ্বস্ত পেরুর জনগন বাম রাজনীতির প্রতি আস্থা হারানোর পর থেকে সে দেশে আর বামপন্থা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নি।
গত ১১ই এপ্রিল সেই দক্ষিণপন্থী পেরুতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ইতিহাসের পট পরিবর্তন হতে দেখলো বিশ্ববাসী। এবারে দেশের সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারী শাসক আলবার্তো ফুজিমোরির কন্যা কেইকো ফুজিমোরির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এক অতি সাধারণ প্রাথমিক শিক্ষক গ্রামের মানুষ পেদ্রো কাস্তিলো। বিখ্যাত মার্ক্সবাদী চিন্তক হোসে কার্লোস মারিয়া-তেগীর অনুপ্রাণিত দল “পেরু লিব্রে”। এই দলের স্বল্প পরিচিত এক শিক্ষক নেতা কাস্তিলোর উত্থান ঘটে ২০১৭ সালের শিক্ষক আন্দোলনের সাফল্য দিয়ে। মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নতি, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরোধ, দেশের সম্পত্তির জাতীয়করণ ছিল ক্যাসিলোর রাজনৈতিক আদর্শ।
এ হেন বামপন্থী ক্যাসিলোকে পেরুর দক্ষিণপন্থী মানুষ মেনে নিতে পারে নি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম রাউন্ডের ভোটে কেইকো ফুজিমোরির থেকে পিছিয়ে যান ক্যাসিলো। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষে অবিশ্বাস্য ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে দেখা গেল বামপন্থী ক্যাসিলোকে। দ্বিতীয় রাউন্ডের পর অন্তিম পর্বে ৯ই জুন ভারতীয় সময় ৫|৩৫ মিনিট পেরুর নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দেয় ৯৯.৭৯% ভোট গণনার পর ফ্রি পেরুর প্রার্থী ক্যাসিলোর ভোটের হার ৫০.২০ শতাংশ এবং কেইকোর প্রাপ্ত ভোট ৪৯.৭৯ শতাংশ। সংখ্যার হিসেবে ক্যাসিলো ৭১৭৬৪ ভোটে এগিয়ে। সরকারী ঘোষনা নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা থাকলেও দীর্ঘকাল পর পেরুতে বামপন্থার প্রত্যাবর্তন নিঃসন্দেহে নতুন ইতিহাসের সূচক।
ক্যাসিলোর বিজয়ের একটু পিছনে তাকালে দেখা যাবে এই জয় খুব সহজ ছিল না। গত তিনবছরে পেরু দেখেছে চার জন দুর্দান্ত, দুর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্রপতি যারা প্রত্যেকেই ঘুষ নেওয়ার মতো অন্যায় কার্য কলাপের দায়ে পদচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছেন। তা সত্ত্বেও এবারের নির্বাচনের সময় দেখা গেছে পেরুর ৮০% সংবাদ মাধ্যম যে মিডিয়া টাইকনের হাতে মুঠিতে সেই “গ্রুপো এলো কর্মামিন্ড” ছিল ঘোর বাম বিরোধী তথা ক্যাসিলো বিরোধী। পেরুর সমস্ত মিডিয়া প্রচার করে, ক্যাসিলো অতিবাম “শাইনিং পাথে”র সমর্থক।
নোবেল জয়ী সাহিত্যিক “ডেথ- ইন- আন্ডিজ” বইয়ের লেখক মোরিও -ভার্গস- ইয়োসো যিনি একদা ফিদেল কাস্ত্রোর অনুগামী ছিলেন তিনিও শাইনিং পাথের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে দক্ষিণপন্থীদের হয়ে “আন্ডিজে থ্যাচারবাদ” এর সপক্ষে প্রচার করেন। এমন কি ব্রিটিশ দ্যা টেলিগ্রাফের পাতায় লেখা হয়, ক্যাসিলোকে সমর্থন করা মানে মার্ক্সবাদী ‘শাইনিং পাথে,র দ্বারা দেশে গেরিলা শাসনের প্রত্যাবর্তন ঘটাতে সাহায্য করা। ফুজিমোরির বিরোধী হয়েও মারিও ভার্গস বলেন পেরুর গনতান্ত্রকে বাঁচানোর একমাত্র পথ কেইকোকে নির্বাচিত করা। তাঁর ছেলে আলভারো ভার্গোস ও বলেন, “আজ আমরা গুরুতর হুমকির মুখে, কমিউনিজমের বিরুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে।” এমন কি গণনার সময় ও পেরুর রাস্তায় বিলবোর্ডে ছড়িয়ে দেওয়া হয়- “কমিউনিজম মানে দারিদ্র।” দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকায় লেখা হয় “একজন কট্টর বামপন্থীকে জিতিয়ে আপনারা পেরুকে কিউবা, বা ভেনেজুয়েলা বানাতে চান।”
ক্যাসিলোর দল এই বিপরীত হাওয়াতেই প্রচার চালায় যে, ক্যাসিলোর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অপপ্রচার চলছে। তার সঙ্গে শাইনিং পাথের কোনো সম্পর্ক নাই। ক্যাসিলোর নিজস্ব প্রচারের মূল বক্তব্য ছিল, চিলির মতোই পেরুতে নতুন সংবিধান রচিত হবে। সংসদ যদি একান্তই গণপরিষদ গঠন না করে তবে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। ফ্রি পেরু ক্ষমতায় এলে রক্ষণশীল ইউ- এস-এইড কে বহিষ্কারের ডাক দেন ক্যাসিলো। তিনি মার্কিন সেনা ঘাঁটির ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন ওয়াশিংটন মদতপুষ্ট “অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেট” এর বিপরীতে “সেলাক ইউনাসুর” কে শক্তিশালী করার কথা। স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রে তিনি জাতীয়করণ নীতি ঘোষনা করেন। ২০২০ সালে পেরুর জিডিপি ১১.১% সারাদেশে শোচনীয় মন্দা এবং এই ছোট্ট দেশেও প্রায় কুড়ি লক্ষ বেকারের কথা তুলে ধরেন। ক্যাসিলোর “ফ্রি পেরু” তে মোরালেসের বলিভিয়া বা র্যাফেলের কোরিয়ার মত প্রাকৃতিক সম্পদের জাতীয়করণ হবে বলেও অঙ্গীকার করেন।
ক্যাসিলোর এই ভাবে মানুষের জীবনের কথা প্রচার দক্ষিণপন্থীরা নস্যাৎ করে দিতে চাইলেও দেশের প্রান্তিক মানুষ বিশেষ করে দক্ষিণ আন্ডিজের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে ক্রমশই ক্যাসিলোর দলের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণীদের “কমিউনিজম মানে দারিদ্র” এর বিপরীতে ক্যাসিলোর শ্লোগান হয় “ধনী দেশে আর গরীব মানুষ থাকবে না।” এই ভাবেই যাবতীয় কুৎসা প্রচারকে পিছনে ঠেলে ক্যাসিলোর জয় সুনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
প্রথম দিকে শহরের ভোটে তরতর করে দক্ষিণপন্থী কেইকো এগিয়ে গেলেও গ্রামের ভোট গণনায় ছবি পাল্টে যেতে দেখা যায়। একসময় কেইকো ক্যাসিলো সমান সমান হয়ে ওঠেন, রাজধানী ‘লিমা’ বা অভিজাত শহর সান-ইসিদ্রোতে কেইকো বিপুল ভোট পেলেও আন্ডিজের প্রত্যন্ত গ্রামের ভোটে হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ক্যাসিলোকেই গ্রহণ করে। দেশের অবহেলিত প্রদেশ উচুরাক্কোতে ক্যাসিলোর প্রাপ্ত ভোট ৮৭%। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার শেষে কেইকো ফুজিমোরিকে পিছনে ফেলে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যান বামপন্থী ক্যাসিলো।
ক্যাসিলোর জয় নিশ্চিত দেখে যথারীতি কেইকোর দল নির্বাচনে অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ তুলে পুনঃনির্বাচনের দাবি তোলে কিন্তু ২০১৬ সালের কথা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এই দাবি খারিজ করে দেন। ক্যাসিলো পেরুর জনগণের উদ্দেশ্যে ঘোষনা করেন “জনাদেশ রক্ষা” করা তাঁর মূল লক্ষ্য। তিনি বলেন “একমাত্র নাগরিকদের নজরদারিই গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে সক্ষম।”
শহরকেন্দ্রিক লড়াইকে গ্রামকেন্দ্রিক করে আদিবাসী সমাজের মানুষদের রাজনীতির সামনের সারিতে আনার জন্যই পেরুর বামপন্থীদের জয় ফিরে আসে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘিরে ফেলার অভিনব কৌশলেই ক্যাসিলোর বাজিমাত হয়েছে। তাছাড়া “হুন্তোস ফর অল পেরু” নামক অপর বামপন্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া, সমকামীদের রক্ষণশীলতা সংশোধনের মতো বিভিন্ন সামাজিক বিষয়কে গুরুত্ব দান, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বলিভিয়ার বিখ্যাত সমাজবাদী নেতৃত্বের পূর্ণ সমর্থন বিশেষ করে অতি বাম নীতি পরিহার ইত্যাদির মতো নীতি গুলিই ক্যাসিলোর জয় সুনিশ্চিত করে।
বামপন্থার বিজয়ে একদিকে যেমন পেরুর ইতিহাসে ক্যাসিলোই প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন, অপর দিকে তেমনি পুনরায় আন্ডিয়ান আদিবাসীদের উত্থান পেরুর ইতিহাসের বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলেই রাজনৈতিক মহল মনে করছে। উদারনীতির নামে দক্ষিণ পন্থীদের অগণতান্ত্রিক অপশাসনের বিপরীতে ক্যাসিলোর উত্থানে মানুষের জন্য মানুষের কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে জনগণের পার্টির নব অভ্যূদয় পেরুকে যেমন স্বস্তির নতুন সমাজ দিতে চলেছে তেমনি বিশ্বের প্রেক্ষিতে সমস্ত দক্ষিণপন্থী উগ্র উদারনৈতিক শাসনের পতন ঘটিয়ে দেশে দেশে প্রান্তিক অবহেলিত নির্যাতিত জনগনের জন্য বামপন্থী মানুষের সরকারের পুনরাগমনের বার্তা সূচিত করে।