কলমের খোঁচা

সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠা দিবসে


পাপিয়া মজুমদার: বিশেষ প্রতিবেদন: চিন্তন নিউজ:১২ই মার্চ:– সারা ভারত গণতান্ত্রিক নারী সমিতির স্থাপনার পর থেকে দীর্ঘ ৪০ (চল্লিশ) বছরের সংঘর্ষ কে(১৯৮১-২০২১) স্মরণ করে গনতন্ত্র, সমতা এবং মহিলাদের মুক্তির লড়াইকে স্মরণ করে ১২ ই মার্চ ২০২১ এ সারা ভারত গণতান্ত্রিক নারী সমিতির জন্মদিবস পালন করা হচ্ছে।

এইড‌ওয়া AIDWA (All India Democratic Women’s Association ) সারা ভারত গণতান্ত্রিক নারী সমিতি) আজ ভারতের লোকতন্ত্র , সমানতা আর মহিলাদের মুক্তির জন্য সবচেয়ে বড় মহিলা সংগঠন।

আজ দেশের ২৩ টি রাজ্যে এই সংগঠন রয়েছে। সদস্যা সংখ্যা রয়েছে প্রায় এক কোটি। এই সংগঠন এর সদস্যা গণ গ্রাম ও শহরে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত রয়েছেন অধিকাংশই।

এই সংগঠনের অনেক সদস্যা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়ে গিয়েছেন বীরত্বের সাথে ও অনেকে শহীদ হয়েছেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় কৃষক শ্রমিক মহিলারা প্রচুর সংখ্যক অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এইড‌ওয়া- র প্রতিষ্ঠাতা ও নেত্রী কর্মীরা মজদুর কৃষকের শিক্ষার অধিকার, নাগরিকের স্বাধীনতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য সব সময় সংঘর্ষ করে আসছে। পাশাপাশি জাতি বিরোধী অসম বিচার ধারার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, লিংগ ও উঁচ-নীচ সকল প্রকার ভেদাভেদের বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই করে আসছে। এই আন্দোলনের শুরুতে এইড‌ওয়ার নেত্রীদের নিজেদের ঘরের ভেতরে ও বাহিরে উভয় ক্ষেত্রেই কঠোর লড়াই করে আসতে হয়েছে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য।
তাদের উভয় ক্ষেত্রের সংঘর্ষের অনুভবের ফলে রাষ্ট্রীয় স্তরে এক মহিলা সংগঠনের স্থাপন হয়।
যারা এই মহিলা সংগঠন স্থাপন করেন তাদের প্রত্যেকের জীবন কঠোর সংঘর্ষ ও বলিদানের ফলে মহিলাদের উপর অত্যাধিক উৎপীড়ন ও অসমানতার পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছে অনেকাংশে।

এইসব কঠোর লড়াই ও আত্ম বলিদানের সাথে যুক্ত সেই মহান মহিয়ষীদের মধ্যে রয়েছেন – সুশীলা গোপালন,দেবকী বারিয়র, মঞ্জুরী গুপ্তা, কনক মুখার্জি, মঙ্গলেশ্বরী দেববর্মা, ইলা ভট্টাচার্য, সুখমতী দেববর্মা,ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সয়গল,জানকী অম্মাল,পম্পা উমানাথ, এম উদ্দোম,এম সূর্যবতী,অহিল্যা রাগনেকর,বিমল রনদীপে,নিরুবেন পঠেল ও আরও অনেক বাহাদুর যোদ্ধাদের আজ গর্বের সাথে স্মরণ করতেই হয়।
এইড‌ওয়া সমাজের সকল স্তরের মহিলাদের অধিকারের জন্য কঠোর লড়াই করে আসছে। সমাজের সামন্ত প্রথা ও সামাজিক প্রচলিত প্রথা- যা মহিলা পুরুষের মধ্যে বৈষম্যতা করেছে, সেই সব বৈষম্যতার বিরুদ্ধে কঠোর লড়াই করে আসছে সাম্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য।
এইড‌ওয়া -র অনেক সংস্থাপক নেত্রী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে মহিলাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা নিয়ে সংসদে উত্থাপন করে অধিকার আদায়ের ভূমিকা পালন করেছেন।
সাম্প্রদায়িকতা ও কট্টর বাদের বিরুদ্ধে, দলিত, আদিবাসী, অল্পসংখ্যক জনজাতি, ট্রান্সজেন্ডার সহ সকল প্রকার শোষিত বর্গের অধিকার আদায়ের জন্য কঠোর লড়াই করে আসছে।
১৯৮১ সালে এইড‌ওয়া -র প্রথম সম্মেলনের পর উঠে আসে দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির ফলে সাধারণ খেটে খাওয়া মহিলাদের উপর প্রতিকূল প্রভাব এসে পড়ে।

গত ৪০ বছর ধরে এইড‌ওয়া সার্বভৌমিক সার্বজনিক বিতরণ প্রনালী কায়েম করার জন্য লাগাতার লড়াই করে আসছে। রেশনে বায়োমেট্রিক প্রণালীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। সাথে আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বলতর দের জন্য বিনামূল্যে ভোজন সরবরাহ করার জন্য দাবি করে আসছে। খাদ্য অধিকার আদায়ের অভিযানে এই সংগঠন এক বিশেষ ভুমিকা পালন করে এবং সাংসদে সংগঠনের প্রতিনিধি রাষ্ট্রীয় খাদ্য সুরক্ষা অধিনিয়ম ২০১৩ তে সবিস্তারে তুলে ধরে। বিজেপি সরকার গ্রামীণ ক্ষেত্রে ৭৫ থেকে ৬০ শতাংশ ও শহরের ক্ষেত্রে ৫০ থেকে ৪০ শতাংশের ও বেশি কমিয়ে আনার চেষ্টা করে আসছে।

সরকারের নবউদারবাদী নীতির ফলে অভুক্ত ও অপুষ্টি জনিত রোগের শিকার হয়। যার ফলাফল কোভিড মহামারীর দিকে নজর দিলেই তা প্রতীয়মান হয়। ভারত আজ বিশ্বে ১০৭ টি দেশের মধ্যে ৯৪ স্থানে অবস্থান করছে অভুক্ত আর অপুষ্টির পরিসংখ্যানে।

এইড‌ওয়া আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বলতর পরিবার গুলোর জন্য ফ্রী ভোজন নিশ্চিত করতে লড়াই করে আসছে। এছাড়া আবশ্যিক প্রয়োজনীয় বস্তুর অধিনিয়মে নুতন সংশোধনের মাধ্যমে খাদ্য অসুরক্ষা বাড়িয়ে তুলেছে। তার বিরুদ্ধেও লড়াই করে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকার যে ৩ কৃষক বিরোধী কৃষি বিল পাস করে চালু করতে চাইছে,যার পরিণতি সরাসরি খাদ্য সুরক্ষার উপর এসে পড়বে, তার দিকে কেন্দ্রীয় সরকার কে অবগত করাতে ক্রমাগত লড়ে যাচ্ছে।
ভূমি আর সম্পত্তির অধিকার পুরুষ ও মহিলা দের সমভাবে প্রাপ্য। এই সমতা আদায়ের জন্য এইড‌ওয়া লড়ে যাচ্ছেন।

মহিলারা জমির মালিকানা হতে বঞ্চিত হওয়ার ফলে মহিলারা কৃষি কাজে নিয়োজিত থাকা সত্বেও কৃষকের মর্যাদায় স্বীকৃতি পাচ্ছে না। যার ফলে কৃষকদের জন্য যে সমস্ত সরকারি সাহায্য সহায়তা রয়েছে, তা হতে মহিলা কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। ১৯৯০ দশক থেকে মহিলাদের মালিকানা পাওয়ার জন্য এইড‌ওয়া লড়ে আসছে।
২০০৬ এ প্রথম কেন্দ্রীয় আইনে আধিবাসীদের জন্য সংযুক্ত পাট্টার ব্যবস্থা প্রদান করা হয়।যেসকল মহিলারা একা রয়েছেন কিংবা ডিভোর্সি ও বিধবা মহিলারা রয়েছেন, তাদের উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য উত্তরাধিকার আইনের সংশোধনের জন্য এইড‌ওয়া সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে।

ইদানিং অধিকাংশ সম্পত্তি কর্পোরেটের হাতে চলে যাচ্ছে। যার ফলে সেই উত্তরাধিকারীরা নিজেদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এইড‌ওয়া প্রতিনিয়ত এইসব মহিলাদের আর্থিক অধিকারের জন্য কঠোর লড়াই করে আসছে।
স্বাধীনতার ৭৪ বছর পর ও মহিলাদের কাজকে সম্মানজনক কাজ হিসেবে দেখা অনেক দূরের স্বপ্ন হয়ে আছে। মহিলা আর পুরুষের মধ্যে সমান কাজে সম মজুরি পাওয়ার অধিকারের জন্য এইড‌ওয়া নিরন্তর লড়ে যাচ্ছে। নিজেদের পছন্দের অধিকার হলো একটা মৌলিক অধিকার। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ার ফলে মহিলারা এই অধিকার হতে বঞ্চিত হচ্ছে।
যেখানে মহিলারা একটি হিংসা মুক্ত বিশ্ব চাইছে, সেখানে দেশে প্রতিনিয়ত গ্যাং রেপ,ধর্ষণ, বলাৎকার করে নির্মম ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। তা বেশ উদ্ভেগজনক বিষয়।

এইসব বিষয় নিয়ে মহিলা আন্দোলনে এইড‌ওয়া সহযোগে লাগাতার হস্তক্ষেপে যৌন উৎপীড়ন, পারিবারিক হিংসা, শিশুদের সাথে বলাৎকার এর বিরুদ্ধে আইন তৈরী করা হয়।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কন্যা শিশুর চেয়ে পুত্র শিশুর প্রত্যাশা বেশি। যার ফলে লিংগানুপাত ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এইড‌ওয়া সেই সমস্যা দূরীভূত করতে এই ধরনের লিঙ্গ পরীক্ষা করার সোনোগ্রাফী ক্লিনিক বন্ধ করতে সফল হয়েছে। এইড‌ওয়া সর্বদাই সাম্প্রদায়িক আর জাতি বাদি হিংসার শিকার পরিবার গুলোকে সাহায্য করে আসছে। প্রতিনিয়ত সদ্ভাব, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল্য ও সামাজিক ন্যায়ের জন্য অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় সংবিধানকে সুরক্ষিত রাখার অভিযানে ও এইড‌ওয়া প্রথমে রয়েছে।
সংসদ ও রাজ্য বিধানসভার আসনে ৩৩% আসনে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের দাবি অনেক দিন ধরে করে আসছে। এইড‌ওয়া- র কর্মীদের বিচার করার ও চিন্তা চেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবসময়ই বিভিন্ন পুস্তক, পত্রিকা, পোস্টার, ক্লাস, সেমিনার, সভা সমিতির মাধ্যমে কর্মীদের চিন্তা-চেতনার প্রসারিত করে আসছে।
আজও আমাদের দেশের বিরাট একটা অংশ অভুক্ত, গরীব, রোজগার হীন, আশ্রয়স্থল হীন অবস্থার কবলে রয়েছে। এইড‌ওয়া সর্বদাই এ হেনো অবস্থার উত্তরনের জন্য লড়ে আসছে।
ক্ষিধা মুক্ত ও হিংসা মুক্ত দুনিয়া বানানোর জন্য সকল অংশের মহিলাদের আসার আহবান করছে এইড‌ওয়া।

বর্তমানে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ও এইড‌ওয়া তার লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প নিচ্ছে আজ তার ৪০ বছর সংঘর্ষের পূর্ণতার দিনে।।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।