কলমের খোঁচা

‘অজর লেনিন’ –অধ্যাপক অমিত দে


চিন্তন নিউজ:২২শে এপ্রিল:–লকডাউনের সকাল গুলো কেমন যেন এপাশ ওপাশ করে গড়িয়ে দুপুরে পৌঁছয় আবার ঠিক একই ভাবে বিকেল আসে, আসে সন্ধ্যা, তারপর রাত আর আবার এসে যায় আরেকটা সকাল।ভাবা কঠিন যে বিশ্বজুড়ে আজ এখনকার ভাষায় ২৪×৭ সব কিছু স্তব্ধ। শুধু চিকিৎসক আর স্বাস্থ্য কর্মীদের এক অদৃশ্য প্রাণঘাতী শত্রুর বিরুদ্ধে ঢাল তলোয়ারহীন অবস্থায় অসহায় লড়াই জারী রয়েছে।সৌরজগতে লকডাউন নেই, তাই দিন আসছে, দিন যাচ্ছে।তারিখের হিসেব, বারের খবর সব এলোমেলো, মনে নেই আজ এ ভাবে জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকার কততম দিন। রোজই কিছু ফোন আসে, আজও এলো।এক ইতিহাসবিদ বন্ধুর ফোন।দু’এক কথার পর বললাম, আপনি এ সময়ের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখে ফেলুন।ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে, আমরা তিন দিনে বিশ্ব ধ্বংসের উপযোগী অস্ত্রসম্ভারে সজ্জিত ছিলাম, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের কোনো পোক্ত পরিকাঠামো আমাদের ছিলো না।আমরা প্রতিরক্ষায় বিপুল অর্থ বরাদ্দ করতাম, কিন্তু সর্বজনীন শিক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণায় অগ্রগতির কথা ভাবতে চাইনি।আর তাই হঠাৎ এক অজানা ভাইরাস এসে আমাদের শক্তিদম্ভ, স্বার্থ, লোভের সভ্যতাকে নাকানি চোবানি খাইয়েছিলো।

উনি বললেন, প্রকৃতি স্বয়ং এক গবেষক।একদা সে এক অগ্নি বলয় ছিলো, তারপরে নিজেকে মুড়ে নিয়েছিলো বরফের চাদরে।তারও পরে সৃজিত হয়েছিলো জল আর তার থেকে সঞ্জাত হয়েছিলো প্রাণ,বৃক্ষজগত ও জীবজগত।

যখনই কোনো প্রজাতি প্রকৃতিরপ্রতি সার্বিক কল্যাণমুখী হতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই প্রাকৃতিক নিয়মে সে বিলুপ্ত হয়েছে।এ ভাবেই একদিন মুছে গেছে ম্যামথ, ডাইনোসর বা নিয়েরডালথাল প্রজাতি।আমরা কি প্রকৃতির প্রতি সেই মনোভাব দেখিয়েছি?১৮৭৬সালে এ বিষয়ে আমাদের সাবধান করেছিলেন এক মনীষী, তাঁর নাম ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস।জীব জন্তুদের বাসভূমিতে হানা দিয়ে তাদের অস্তিত্বের ঘনত্ব বৃদ্ধি করেছি, ফলে নতুন নতুন ভাইরাস এসেছে, বলা ভালো অনেকাংশে আমরাই এনেছি।

এই সব ভাবনা জাগিয়ে ফোনটি শেষ হলো।আর ঠিক তখনই চোখে পড়লো আজকের তারিখটি।চমকিত হলাম।মনে হলো একজন ছিলেন, যিনি মানুষের এই মানুষ ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুগান্তব্যাপী অপরাধ মুছে এক উন্নত, বাঞ্ছিত জীবনের দিকে আমাদের এগিয়ে দেওয়ার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন।এক আদর্শ অভিমুখ সৃষ্টি করেছিলেন।তিনি লেনিন।আগামী কাল তাঁর দেড়শতম জন্মদিন।

মনে হলো আজ যে অপরাধের মাশুল আমরা দিচ্ছি, সে বিষয়ে তিনি কী করেছিলেন.কতটা করেছিলেন, দেখা যাক।সময় পেয়েছিলেন সাত বছর।১৯১৭থেকে১৯২৪।ওই স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি প্রতি লক্ষ জনে চিকিৎসকের সংখ্যা ১৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৪৩০এ নিয়ে গিয়েছিলেন।কিন্তু প্রয়োজনের তাগিদ ছিলো আরো, তাই তিনি আরো অনেক চিকিৎসা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ করেন, তাঁদের বলা হয় ফেন্ডসার।অঞ্চলভিত্তিক ভাবে স্থাপন করেন মেডিক্যাল স্টেশন, ডিসপেনসারি, পলি ক্লিনিক ও হাসপাতাল।জনসাধারণ সম্পূর্ণ বিনা খরচে এগুলির সহায়তা পেতেন।এ ছাড়াও ছিলো ইমারজেন্সি মেডিক্যাল সার্ভিস।অসুস্থ, বৃদ্ধ ও কোনো কারণে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য বীমার ব্যবস্থা ছিলো। ১৯৩৬এ স্তালিন যে সংবিধান সংশোধন করেন তার ধারা ১২০তে এগুলিকে অপরিবর্তিত রাখা হয়। নারী ও শিশু চিকিৎসায় তিনি যে অসামান্য পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, সে কথা এখানে মূল বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় বলে উল্লেখ করলাম না।৭০০টি বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিলো।প্রখ্যাত বিজ্ঞানী পাবলভের গবেষণাগারটিকে একাডেমি অফ সায়েন্সে রূপান্তরিত করা হয়।এই সমস্ত কর্মকান্ডে গুরুত্ব দিয়েপ্রায় সাধ্যাতীত ভাবে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিলো।রাশিয়ায় তখন টাইফাস, টিবি ও যৌন ব্যাধি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে রেখেছিল।তাঁর পরিকল্পিত পথেই দেশ এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়।

আজ একটু চোখ মেলে দেখলেই ধরা পড়বে যে দেশগুলি আজকের এই কোভিড-১৯ যুদ্ধে এগিয়ে আছে, যেমন ভিয়েতনাম বা কিউবা,-তারা সকলেই সমাজতান্ত্রিক ।আর ধনতন্ত্রের চূড়ায় আসীন দেশগুলিতে মানুষের অসহায়ত্বের সীমা নেই।

সব দেশের মানুষই আমাদের সহযাত্রী ।বিশ্বজনীনতার বোধই আমাদের আদর্শ।এ পৃথিবী নিরাময় হোক।

পরিশেষে বলি, ১৫০বছর অতিক্রান্ত, তবু আজও বিপ্লব স্পন্দিত প্রতিটি তরুণের বুকে একই ভাবে বাজে”আমিই লেনিন”,এ বিশ্বাসে আমি অটল।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।