দেশ

নাগরিকত্ব বিল ও বামপন্থীদের ভূমিকা


চৈতালী নন্দী, চিন্তন নিউজ, ৫ ডিসেম্বর: নাগরিকত্ব খসড়া বিলটি প্রথম আইন সভায় পেশ করা হয় ২০১৬ সালে তৎকালীন বিজেপি সরকারের উদ‍্যোগে। কিন্তু বিরোধীদের চাপে সরকার বাধ‍্য হয় বিলটি যৌথ সিলেক্ট কমিটিতে প্রেরন করতে। তৎকালীন সিপিআইএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম সিলেক্ট কমিটিতে এই বিলটির উপর ভিন্নমত পোষণ করেন। ২০১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি লোকসভায় তিনি এই বিলটি প্রত‍্যাহারের দাবী জানান। কারন তাঁর মতে এটি ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। সংবিধানের ৫ থেকে ১১নং ধারা  এবং মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদটি লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম, শ্রেনী  সম্প্রদায় বা ভাষা নির্বিশেষে সাম‍্যের মূল সূত্রগুলিকে  গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু এই বিলটি এই সব বিষয়গুলোকে লঙ্ঘন করছে। তিনি আরও বলেন যে এই বিল সংবিধানের নিছক পরিবর্তন নয়, এটি এমন একটি আইন যা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মৌলিক চরিত্রকে পরিবর্তন করবে।

নাগরিকত্ব বিলের খসড়ার উপর ভিন্নমত পোষন করার সময় সিপিআইএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম কয়েকটি বিষয় উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, যে ভাবে বিলটি নিয়ে সিলেক্ট কমিটিতে পর্যালোচনা হয়েছে তা উদ্বেগের বিষয়। এই কমিটি গঠিত হবার পর থেকে প্রায় তিন বছর নাগরিকত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস‍্যুকে এই বিলটি কখনোই যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেনি। মাসের পর মাস বিলটি ফেলে রেখে এই কমিটি শীতকালীন অধিবেশনের আগে ১০ দিনের মধ‍্যে তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করে। যা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই ন‍্য়।

পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা এবং আন্দামানের মতো রাজ‍্যগুলিতে ‘স্টেক হোল্ডার’ এর সঙ্গে যথাযথ ভাবে মতবিনিময় করেনি। মূলতঃ এই অঞ্চল গুলিতেই বাঙালি অভিবাসীরা, প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায় হয়রানির শিকার। এটি একটি আধিপত‍্যবাদী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। মোট কথা ‘স্টেক হোল্ডার’ এবং সংশ্লিষ্ট ব‍্যাক্তিদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদে আলোচনার প্রয়োজন ছিল।

ভারতীয় নাগরিকত্ব একটি মৌলিক অধিকার যার সঙ্গে ভারতীয় সংবিধান ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত।ভারতীয় সংবিধানের প্রজাতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, নাগরিকত্ব প্রশ্নে লিঙ্গ, ধর্ম, সম্প্রদায়, অঞ্চল বা ভাষা নির্বিশেষে সকলের সমতার মৌলিক অধিকার।

প্রস্তাবিত বিলের পিছনে ‘মেকিয়াভেলিয়ান’ লক্ষ‍্যও পরিলক্ষিত হয়, যখন দেখা যায় যে গনতান্ত্রিক ও গঠনমূলক আলোচনা ছাড়াই ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে এমন একটি শক্তির দ্বারা যারা স্বাস্থ্যকর বিতর্ককে গনতান্ত্রিক প্রহসনে পরিনত করেছে।ভারতীয় নাগরিকত্বের উৎস সংবিধানে প্রনীত মৌলিক অধিকার, যা কোনো ভাবেই ধর্ম বা দেশ নির্দিষ্ট হতে পারে না। আসলে এই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল সমস্যার সমাধান না করে সমস‍্যাকে তীব্রতর করছে। মানুষের মধ‍্যে তৈরী করছে বিভেদ ও সন্দেহের বাতাবরন।

প্রস্তাবিত এই সংশোধন অনুযায়ী এখন থেকে নাগরিকত্ব স্থিরীকৃত হবে আবেদনকারীর ভাষা এবং ধর্মের ভিত্তিতে। আসলে এটি আরএসএস এর সংকীর্ণ মতাদর্শেরই বহিঃপ্রকাশ। যারা এটিকে মনে করে “THE UNFINISHED AGENDA OF PARTITION” ইতিমধ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশ ধর্মীয় বিভাজনের ভয়ঙ্কর পরিনতি দেখেছে। এই সংশোধনী আরও বহু রক্তক্ষয় ও মানব হত‍্যার সাক্ষী হবে, যেমন ১৯৮৩ সালে আসামে ঘটেছিল।

যৌথ সাংসদিক কমিটি বিরোধীদের সমস্ত সংশোধনী বাতিল করার খসড়া প্রতিবেদন গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই বিল আইনে পরিনত হলে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের মূল ভিত্তিকে কুঠারাঘাত করবে এবং এই পরিবর্তনের প্রভাব দেশ এবং উপমহাদেশের ক্ষেত্রে হবে অত‍্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। প্রস্তাবিত বিলটি কেবল ভারতীয় মুসলমানদের নিরাপত্তা বোধই নয়, বাংলাদেশের হিন্দুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা এবং কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের ঐতিহাসিক অবস্থানের বিশ্বাসযোগ‍্যতার উপর প্রভাব ফেলবে বলে মহম্মদ সেলিম মনে করেন। এই বিল আসাম চুক্তির প্রতিও চরম বিশ্বাসঘাতকতা। ভারতীয় সংবিধান কর্তৃক দ্বিজাতিতত্বের খারিজ হওয়াকেও এই প্রস্তাবিত আইন নস‍্যাৎ করে, ভারতীয় মুসলিমদের সমনাগরিকত্বের অধিকার অস্বীকার করেছে।

সাংসদ সেলিমের মতে, “A hard national question across the political spectrum is in order.The implication of the bill are far more profound,ill_conceived and downright dangerous.” তাঁর মতে এই বিল অবিলম্বে প্রত‍্যাহার করা উচিৎ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।