কলমের খোঁচা

ধারাবাহিক উপন্যাস ‘কলির রাধা’পর্ব-২–গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ’:১লা এপ্রিল :- দীপের নিথর শরীরটা তেরচা ভাবে দেখা যাচ্ছে নীরা যেখানটায় বসে আছে, সেই খান থেকে।রমার এই অস্বাভাবিক রকম শীতল আচরণ নীরাকে আশ্চর্য নয়, বিরক্ত করছে।সেবার এই বাড়ির ই তিনতলাতে, দীপের স্টাডিতে একেবারেই হঠাৎ করে রমাকে ঢুকতে দেখেও কেমন যেন একটা অদম্য জেদের বশে কেমন যেন একটা ডোন্ট কেয়ার মেন্টালিটি ভর করেছিল নীরা কে।আস্তে করে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বিছানার চাদর টা ছুঁড়ে দিয়েছিল দীপের দিকে।সেদিন যেন একটা অধিকার বোধেই পেয়ে বসেছিল নীরাকে।ভুলে গেছিল রমা দীপের বিয়ে করা বৌ ,আর সে দীপের ছোটমাইমা। একই বিছানায় এভাবে নিজের ছোটমাইমার সঙ্গে নিজের বরকে দেখে কোনো রিঅ্যাক্ট করে নি রমা।কেন করে নি? রমা কি এই সম্পর্ক, যেটা সে তাদের বিয়ের পরের দিন ই ওদের কারখানার পাহাড়াদার বাদলদার কথার ইঙ্গিতে একটু হলেও আন্দাজ করেছিল, সেই সম্পর্কের এমন হাতে নাতে প্রমাণ পাওয়া স্বত্ত্বেও কেন বরফের মতো ঠান্ডা হাত দিয়ে দীপের ফিল্মি ম্যাগাজিন, ভিসিপি, ভিডিও ক্যাসেট ঠাসা চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা যতোটা শব্দ করে খুলেছিল, তার থেকে যেন কয়েক লক্ষ গুন নীরবে বন্ধ করে দিয়ে দোতলায় নিজের শোওয়ার ঘরের খাটের উপরে উপুর হয়ে পড়ে কেবল ফুলে ফুলে কেঁদে উঠেছিল?
গহীন মফস্বলে রমার বাপের বাড়ি।বাবা চাকরি করেন সরকারী ডাইরক্টরেটে।প্রমোটি ইঞ্জিনিয়ার।এক ভাই, এক বোনের আর বাবা , মায়ের সুখের ছোট্ট সংসার। মেয়ে দেখতে গিয়ে নীরার মনে হয়েছিল, দীপের জন্যে একদম আইডিয়াল।সাত চড়েও ‘ রা’ কাড়বে না এই মেয়ে।কারন, ভাইটা মানসিক অসুস্থ।বাপের ট্যাকের তেমন একটা জোর নেই।তার উপরে মা ও চিররুগ্ন।বৌয়ের  আর আধপাগলা ছেলের ওসুধ কিনতেই বুঝি বাপের মাস মাইনের আদ্দেক গলে যায়।শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে কেমন আছে না আছে, তা দেখার সময় পাবে কখন? তা ছাড়া বাপের বাড়ির জোর থাকলে পরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ট্যা ফো করবার সাহস পায় মেয়েরা।এই তো বাপের বাড়ির হাঁড়ির হাল।এ মেয়ে বিয়ের পর ভালো খাওয়া দাওয়া ,ভালো শাড়ি গয়না, বরের শ্বশুর বাড়ির দিকে একটু আধটু মনোযোগ আর দুদিন বাদে পেট বাঁধাতে পারলে আর কিচ্ছুটি চাইবার থাকতে পারে না– ভেবেই এই মেয়ে কে বৌ করে নিয়ে আসার জন্যে ননদের উপর সবথেকে বেশি ইনফ্রুয়েন্স খানিয়েছিল নীরা।আর ছোটমাইমার যখন পছন্দ,তখন দীপ তো  ‘ হ্যাঁ’ ,’ না’ কোনো কিছু বলার অবস্থাতেই থাকতে পারে না।ছোটমাইমাকে বাইকের পিছনে নিয়ে আশে পাশের গ্রাম গুলোর ভিতরে চলে যাওয়া ছিল দীপের তখন প্রতিদিন বিকেলের রুটিন।মফস্বলী শহর লাগোয়া গ্রাম ছিল দীপের ভীষণ ভালোলাগা জায়গা।হোক না মফস্বল শহর , তবু বড় রাস্তার ধারে বাড়ি হওয়ার দরুন সারাদিন বাস লরি ভোঁ ভোঁ হর্ন , রিক্সার প্যাঁক প্যাঁক  আওয়াজ, সাইকেলের ঘন্টি — একদম অসহ্য লাগে দীপের। তাই বিকেল হলেই বাইকটা নিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে শহরের ছোঁয়া লাগা,  আবার না লাগা ,না  এঁদো গ্রাম , না  আবার না মফস্বলী  শহরের উগ্র গন্ধ আছে–  এমন জায়গাগুলোতে যেতে খুব ভালোবাসে দীপ।আসলে কলেজে ঢুকে সুদেষ্ণার সঙ্গে সম্পর্ক টা তৈরি হওয়ার পর ওকে নিয়ে ‘ অচেনার আনন্দ’ খোঁজার ভিতর দিয়ে সুদেষ্ণার কাছে একটা বোহিমিয়ান বিভূতিভূষণ আর শক্তি চ্যাটাজ্জের পাঞ্চ ইমেজ তুলে ধরতেই এই শহর লাগোয়া গ্রাম চেনার নেশা ঢুকে পড়ে দীপের ভিতরে।
সুদেষ্ণার মায়ের কাঁঠালপোতায় ছিল বিউটি পার্লার।দীপদের সেই ছোট মফস্বলে সেটাই ছিল প্রথম বিউটি পার্লার।সুদেষ্ণার মায়েরা এক দঙ্গল ছিল দীপের ছোট মাইমা নীরা খুব কাছের বন্ধু।ওদের অনেকের ভিতরেই তখন সোশাল ওয়ার্ক করার নেশা চেপেছে।আর দীপের ভিতরে নেশা জাগছে সত্যজিৎ, ঋত্ত্বিক হওয়ার।বাবা মারা যাওয়ার পর দাদা হঠাৎ একটা ফেলোশিপ নিয়ে ট্রিনিটি কলেজে পড়তে চলে গেল লন্ডন।তাই বাবার ব্যবসাটা দীপ নিজে দেখাশোনা করতে গিয়ে ব্যবসার প্যাটার্নটাই বদলে ফেলল।ওই জঙ্গল ইজারা নেওয়া। সে জন্যে মশা, মাছি আর ম্যালেরিয়াকে সম্বল করে, এম এল এ দের ,লোকাল রুলিং, অপজিশান পার্টির নেতাদের তেল তামাক করে ব্যবসা চালানোর টেপারামেন্ট দীপের নেই।বাপের এতোকালের জঙ্গল ইজারা নিয়ে, লোকাল জঙ্গলবাসীদের মাথায় টুপি পরিয়ে পারমিটের পঞ্চাশ টা গাছের জায়গায় রাতের অন্ধকারে দেড়শো টা গাছ চালান করার ব্যবসা থেকে শৌখিন ফার্নিচারের ব্যবসাতে সবটা কনভার্ট করিয়ে একটা বিপ্লবী আত্মতৃপ্তি ই পেল দীপ।এই তৃপ্তি পেতে তাকে তখন একই সঙ্গে উষ্ণতায় ভরে রেখেছে তার ছোটমাইমা নীরা আর প্রেমিকা সুদেষ্ণা।দীপের মা সাংসারিক ঘোরপ্যাচের ভিতরে ঢোকার মতো মানসিক অবস্থায় তখন নেই ।আর তার বাপের বাড়ির কেতায় মেয়ে হওয়ার দরুন প্রাইমারি স্কুলে র গন্ডি পেরনো তার পক্ষে সম্ভব হয় নি।যদিও দীপের দাদামশাই গণেশমাষ্টার নিজের মেয়েদের গন্ড মুর্খ করে রাখলেও ছেলেদের পড়াশুনোর পিছনে খরচাপাতি নিয়ে এতোটুকু কিপটেপো কখনো করেন নি।   নীরা ,সুদেষ্ণার মা, বিশাখা– নীরার বন্ধু, এমন আরও অনেকে মিলে একটা সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললো ‘পূর্বাশা’। মোহাম্মদ ইউনুসের মাইক্রো ফিন্যান্সের   কনসেপশন এপার বাংলার মফস্বল শহরগুলোতে তখনও সেভাবে না পৌঁছলেও ,’পূর্বাশা’ রিক্সাওয়ালা, সবজিওয়ালা, মাছওয়ালা ,চালওয়ালী– সবাইকে দিতে থাকলো অল্প অল্প করে ঋণ তাদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। দীপের মফস্বল লাগোয়া গ্রাম ভ্রমণ ‘পূর্বাশা’ কে গ্রামের মানুষদের ভেতরে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে খুব সাহায্য করল। দীপের বন্ধু আবির অবশ্য দীপকে  একবার জিজ্ঞাসা করেছিল;আচ্ছা মানি লেন্ডিং  করতে গেলে তো রিজার্ভ ব্যাংকের পারমিশন দরকার ।রিজার্ভ ব্যাংকের পারমিশন ছাড়া কেউ কি ধার দেওয়া, ধার দেওয়া,  ফেরতের সময় সুদ নেওয়া — এগুলো করতে পারে ? ছোট ভাই মাইমা সাংগঠনিক দক্ষতাতে মুগ্ধ দীপ বন্ধু আবিদের তোলা প্রশ্ন কে কোনো গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ই মনে করেনি ।আসলে দাদা বিদেশে চলে যাবার পর বাবার ব্যবসার দৌলতে বাড়ির টাকাপয়সা গুলো নড়াচড়া করবার সব অধিকার তখন একক ভাবে দীপের।ওর মা তেমন টাকা-পয়সার ব্যাপার বোঝে  না ।আর স্বামীর মৃত্যুর শোক ,বড় ছেলের বিদেশে চলে যাওয়া– এইসব ধাক্কায় টাকা পয়সা খুঁটিনাটি তে তখন তিনি আর তেমন একটা ঢুকতেও চান না ।  তাছাড়াও স্কুল কলেজে পড়াশোনা করতে না পারার সুবাদে  দীপের মায়ের একটা ধারণা, সিনেমা ব্যাপারটা দীপ এতটাই বোঝে যে, ও যদি সিনেমা তৈরি করে, তাহলে বেঁচে থাকলে সত্যজিৎ , ঋত্ত্বিকদের  ভাত জুটতো না। আর এখন মৃণাল  বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ দের ভাত জুটবে না । মায়ের মতোই দীপের  দু একজন বন্ধু ,কাবু ,রনি, রিঙ্কু– এমন কয়েকজন যারা মনে করে, সত্যজিৎ আর ঋত্ত্বিকের জয়েন্ট ক্লোন দীপের ভেতর আছে ,তারা ছাড়া অন্য কোনো বন্ধুদের কথা কে সেভাবে পাত্তা দিতে অভ্যস্ত নয় এখন আর দ্বীপ ।যদিও  ছোট মাইমা  তার ভেতরে   সবথেকে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ছোট মাই মার কথা দীপের কাছে বেদ, বাইবেল, ত্রিপিটক।  সুদেষ্ণার কথা সবটা না মানলেও একদম ফেলে দেয় না অবশ্য দীপ।এর কারন অবশ্য দীপের মনে হয়, ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ছোটমাইমা যতোটা গায়ে পড়া, ডাক্তার বরের দারুন রোজগার স্বত্ত্বেও দীপের কাছে আবদার করে বসে হীরের কানের টপ, সুদেষ্ণা কিন্তু তেমনটা নয়।শরীর যখন দেয় সে, একদম মন থেকেই দেয়।সুদেষ্ণার এই দেওয়াতে কোনো কার্পণ্য থাকে না।কোনো দেনা পাওনার হিশেব- নিকেশ থাকে না।  মফস্বল শহর গুলি তখনও আজকের মত বৃদ্ধাশ্রমের পরিণত হয়নি ।রোজগেরে ছেলেরা বাড়ি থেকেই কলকাতার অফিসে যাতায়াত করতো। আরো দূর দূরে অফিস করলেও সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরতো। কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে চলে যাওয়ার রেওয়াজ মফস্বল কে তখনও আজকের মতো এতটা গ্রাস করে নি। তাই বাড়িতে অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখার মানুষজনের অভাব আজকের মতো এতটা ভয়ঙ্কর ছিল না। তবু ও নদী আর রেল লাইনে র বুকের ভিতলে চেপে বসা  এই মফস্বল শহরটিতে  কিন্তু বাড়িতে বাড়িতে  আয়া কনসেপশন টা নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নীরাদের  সোশ্যাল অরগানাইজেশন ‘পূর্বাশা’র একটা বড় ভূমিকা আছে। লোকের বাড়ি বাসন মাজা,  কাপড় কাচার থেকে অনেক কম খাটনির, আবার মাইনে টাও বেশি   কখনো কখনো দুপুরের খাওয়া ও জুটে যায়। জল খাবার,  চা ,বিস্কুট, মুড়ি  ,সিঙ্গারা টাও  টুকটাক জোটে। এসবের তাগিদেই ‘পূর্বাশা’র আয়া সরবরাহের ভেতর দিয়ে সমাজসেবার ব্যাপারটা ভালোই জমে উঠলো। দীপের ও বিকেল বেলায় বাইকে বসে   নীরার হাতটা নিজের কোমরে জড়িয়ে গ্রাম দেখতে যাওয়ার বিলাসিতার ভেতর দিয়ে গ্রাম ভেঙে শহরে সমাজসেবী সংগঠন পূর্বাশা তে আয়ার কাজ নিতে আসা মেয়ের অভাব হলো না ।মফস্বলের একটু লোকজন কম, নিসঙ্গ বৃদ্ধ একলাটি পড়ে থাকে,এমন  বাড়িতে ফিজিওথেরাপি ট্রেনিং দিয়ে মেয়েদের পাঠানোর ব্যাপারে নীরার ইনিশিয়েটিভ টাই ছিল সব থেকে বেশি। সুদেষ্ণার মায়ের বিউটি পার্লারে কাজ করতে আসা মেয়েরাও  অবশ্য এক্ষেত্রে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না ।আবির  একদিন মজা করে জিজ্ঞেস করেছিল দীপকে;হ্যাঁরে তোর ছোট মাইমা ‘পূর্বাশা’র মেয়েদের ফিজিওথেরাপি ট্রেনিং দেন? একটু ঠেশ মেরে বলেছিল আবির ;

    ্ডা্ক্তা্রে্ তো! এফ আর সি এস ,নন মেট্রিক না হয়ে যান না!

                   কোনো রকম সমালোচনা সহ্য করা দীপের ধাতে নেই। তার কাজের দিকে কেউ আঙ্গুল তুলতে পারে, এটা সে ভাবতেই পারেনা। আর’ বন্ধু’ বৃত্তে ঘেরা দীপ এটাই ধরে নিয়েছে ;সে যেটা করে, যেটা ভাবে, যেটা দেখে ,যেটা বলে, সেটাই ঠিক ।

             দীপ কখনো কোনো ভুল করতে পারে না ।দ্বীপ কখনো কোনো অন্যায় করতে পারেনা। কুয়োর  ভিতরে থির বিজুরি জলের মতো নিজেকে  ভাবতে থাকা দ্বীপ ভীষণ রেগে গেছিল সেদিন বন্ধু আবিরের কথায় ।

                 তারপর কয়েক মাস কথা  তো  দূরের বিষয় ,আবিরের  সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ পর্যন্ত করে নি দীপ। তবে এক্সপ্রেস ওয়ে পেরিয়ে ব্লাইন্ড  স্কুলের পেছনে ধলচিঠি গাঁয়ের সাঈদা যেদিন পূর্বাশার অফিসে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলেছিল তার ফিজিওথেরাপীর অভিজ্ঞতার কথা,  তখন একটু হলেও আবিরের সতর্ক করে দেওয়ার কথা গুলো দীপের মনে পড়েছিল ।

                    তারপরের দিনই খুব ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে যখন সুদেষ্ণা কে দীপ বলে;

             কি দরকার তোমার মায়ের ওই পার্লারের মেয়েগুলোকে দিয়ে লোকেদের বাড়িতে ফিজিওথেরাপি করানোর?

                     স্যালোয়ারের গায় ওড়নাটা পিন দিয়ে আটকাতে আটকাতে সুদেষ্ণা ঝাঁজালো সুরে বলেছিল;

                তোমার মাইমা,  নীরা কাকিমা যে এইসব ফিজিওথেরাপি গুলোর কন্টাক্ট করে দেন তোমার ছোট মামার পেশেন্টদের ভেতরে থেকেই তা তুমি জানো না ?ন্যাকা সাজ ছো?  আঙুল তুলছো আমার মায়ের দিকে? আগে তাকাও নিজের ছোট মাই মার দিকে। দ্যাখো ,তোমার ছোট মাইমা পূর্বাশা কে সামনে রেখে অসহায় ,গরীব ,পড়াশুনো না জানা মেয়েগুলো কে দিয়ে কি করাচ্ছে, তারপর আঙ্গুল তুলতে এসো আমার মায়ের দিকে।

                 জামার বোতাম আটকাতে আটকাতে  কোনো কথা আর বলতে পারেনি দীপ ।ঘোলা , ঘোলা চোখ করে তাকিয়েছিল সুদেষ্ণার দিকে।তারপর সোজা চলে গেলে গিয়েছিল ছোট মামার বাড়ি।

ছোটমামা বাড়ি তে না থাকার সুবাদে মেঘ না চাইতেই জলের মতো দীপকে নীরা পেয়ে গেলেও উঠতি বয়সের অতি স্বাস্থ্যচেতনায় এক ই দিনে তিনবার ইজাকুলেশনে দীপ মোটেই ইচ্ছুক ছিল না।তার উপরে তখন তার মাথায় ঘুরছে সুদেষ্ণার কান গরম করে দেওয়া কথা গুলো।   

                দীপ তুই তোর ছোট মাইমার থেকে সুদেষ্ণার কথাতেই সব থেকে বেশি বিশ্বাস করলি?

 তুই তোর ছোট মাইমাকে এতদিনে এই চিনলি?–

           অন্তর্বাস হীন নীরার  নরম শরীরের উগ্র  চাপের সঙ্গে সঙ্গে ছোট মাইমার  প্রিয় সুগন্ধির গন্ধীতে  যেন মাতাল হয়ে গেল দীপ। বয়সন্ধির স্বাস্থ সচেতনতায় ভেসে গেল তিনবার ইজাকুলেশন না করার  সেই সব অদ্ভুতুড়ে তত্ত্ব ।

                      আর এই সুযোগেই নীরা খুব সহজেই দীপের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারলো সুদেষ্ণার মায়ের’ বল্লরী বিউটি পার্লারে’র অন্ধকার জগতের ব্যবসার কথা। সে ব্যবসার অস্তিত্ব থাকুক, আর না থাকুক, নীরা বুঝেছিল; দীপ আর  সুদেষ্ণার সম্পর্কটা যদি পাকাপোক্ত হয়ে যায় ,তাহলে শক্ত মেরুদন্ডের মেয়ে সুদেষ্ণার মোহিনীমায়া থেকে দীপ কে নিজের বেড়াজালে আর আটকে রাখতে পারবে না সে।

                       তাই হাইডোজ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের উদ্দেশ্যেই বিছানায় যাওয়ার আগে দীপ কে কোন রকম সতর্ক হওয়ার সুযোগ ইচ্ছে করেই নীরা দেয়নি। নীরার পেলব অথচ সুঠাম, কোমল অথচ বায়বীয় , সৌন্দর্য আর  মোহময়তার  আবেশে ভরা মুগ্ধতার জোয়ারে ভাসতে ভাসতে  দীপের মনেও আসেনি সতর্ক হওয়ার বিন্দুমাত্র তাগিদ।

                      সেদিনের অসতর্কতার জেরে কিছুদিন পরে যখন লাজুক লাজুক মুখে কলকাতার একটি নার্সিংহোম থেকে নীরা বেরিয়ে আসছিল, দীপ কিন্তু তখন একদম চোখে চোখ রেখে তার ছোট মামা বারীনের  দিকে তাকাতে পারছিল না। বারীন যে খুব একটা সন্দেহের তালিকার বাইরে গোটা ব্যাপারটা রেখেছিল– এমনটাও কিন্তু নয় ।

                               নিজে ডাক্তার হওয়ার সুবাদে এক খন্ড মাংস পিন্ডের শরীরে সিরিঞ্জ ফুঁটিয়ে ডি এন এ টেস্টের জন্য ব্লাড  কালেক্ট করে রাখতে কিন্তু সে ভোলেনি ।মুখ ফুটে সেই রিপোর্টের কথা না বলেছে দীপকে, না বলেছে নীরাকে।

                   নীরার সেদিনের ইচ্ছাকৃত অসতর্কতায় খুব সহজেই সুদেষ্ণার মায়ের ‘বল্লরী বিউটি পার্লারে’র আড়ালে দেহ ব্যবসার গল্পটি দীপের মাথায় ঢুকিয়ে, দীপ আর সুদেষ্ণার ভেতরে একটা শক্তপোক্ত দেয়াল তুলে দেওয়া শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছিল দীপেল ছোট মাইমার পক্ষে।

             সুদেষ্ণার সঙ্গে সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পর নীরাই প্রথম ব্যস্ত হয়ে পরে দীপের বিয়ে দেওয়ার জন্য ।ভাই বউয়ের প্রস্তাব দীপের মা সহজ ভাবেই  নিয়েছিলেন।নীরা আর দীপের সম্পর্ককের বিষয়টাকে  সেভাবে কিছু আন্দাজ না করলেও পাড়াপড়শি, কাজের লোকেদের একটু আধটু কানাঘুষো যে দীপের মায়ের কানে যায়নি ,তেমন টা তো আর নয়।

                 সবদিক সামাল দিতেই দীপের মা ভেবেছিল ;তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেলে, ছেলেপুলে কোলে এলে, একটু আধটু যা  বেসামাল থাকে, তা ঠিক হয়ে যাবে। কারন , ডাক্তারি পড়ার সময় নিজের ভাই বারীনের  সঙ্গে তাদেরই পিসতুতো বোন ব্যানার সম্পর্ক নিয়ে ওদের আত্মীয় মহলে তো কম কানাঘুষো হয়নি।

                          বারীনের  বিয়ের পরে কোথায় গেল সেই ব্যানা? আর কোথায় উঠে এসেছে আজ বারীন। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে সেসব কানাঘুষো।

                     তাই নীরা যখন দীপের বিয়ের প্রসঙ্গ তুলল, একটু বেশি আগ্রহ দেখিয়ে ফেলল দীপের মা চন্দনা।মেয়ে পছন্দের ভারও খানিক টা যেচেই নীরার উপরে ছিল চন্দনা।পাত্রী নির্বাচনের ভার  উপরই পরলো দেখে  নীরা, বহু দেখে শুনে, নিজের পোষা পাখি টি যাতে নিজের বশে ই থাকে,  সেই তাগিদেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করেছিল আপাত নিরীহ, টাকা কড়ির দিক থেকে দীপের পরিবারের থেকে অনেকটাই কমজোরি, বাপ- মা – ভাই -বোনের তেমন জোর না থাকা এই রমাকেই। 

                             রমা কে নিজে নির্বাচন করার জন্যে রমা খানিকটা তার বশে থাকবেই বলে ধরে নিয়েছিল নীরা।তবে নিজের থেকে কোনো কিছুকেই টেকেন ফর গ্রান্ডেড ধরে নিলেই সেটা যে সামাজিক বা পারিবারিক ভাবে টেকেন ফর গ্রান্টেড হয়ে যাবে– এমন টা তো ধরে নেওয়ার কোনো কারন নেই।তাই অল্প দিন এর ভিতরেই নীরা বুঝে যায় নীরা , যতোটা ঢোড়া সাপ বলে সে ঠাওড়েছিল রমা কে, রমা কিন্তু ঢোঁড়া তো নয় ই বরংচ কাল কেউটে।আঘাত পেলে তক্ষণাৎ ছোবল দেওয়ার সুযোগ যদি নাও পায়, আঘাতকারীকে চিনে রেখে ঠিক সময় মতো ছোবলে বিষ ঢেলে দেয়।

             সেদিন চিলেকোঠার ঘরে নীরা আর দীপ কে ও ভাবে দেখে ফেলার পর রমার জ্বলন্ত চোখ অথচ ঠান্ডা সাপের মতো শরীরী ভাষা দেখে কালনাগিনী ছাড়া আর কিছু তাকে ভাবতে পারে নি নীরা।। ক্রমশ


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।