কিংশুক ভট্টাচারিয়া:চিন্তন নিউজ:১লা এপ্রিল:-এইমুহুর্তে গোটা বিশ্বের সাথে ঐ মারাত্মক সংক্রমণে আমরাও সংক্রামিত। শেষ খবর পর্যন্ত আমাদের দেশে সংক্রামিতের সংখ্যা ১৬৫০এর অধিক জন। মৃত শতাধিক জন। কেউ কেউ সংক্রমণের এই ধীর গতির হারের বৃদ্ধিতে সরকারগুলির সময়োচিত পদক্ষেপকেই সমর্থন করছেন। এটাতে কেউ কেউ জয়সীমার ব্যাটিং স্টাইল দেখতে পাচ্ছেন। আসলে তাঁরা এর ধরনটা সম্পর্কে সঠিক খোঁজ পাননি। সে যাই হোক একটু এর ফলে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান এর সামগ্রিকতা একটু পর্যালোচনা করা যাক।
বেশ কয়েকদিন ধরেই বেশ কিছু তথ্য বহুল যুক্তিপূর্ণ আলোচনা সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে। আমি চেষ্টা করবো কয়েকটি ভাগে লেখাটা উপস্থাপনের। আতঙ্ক,ও সতর্কতা, পরবর্তীতে অর্থনৈতিক জটিলতা ও দুর্ভিক্ষ ,সরকারের কর্তব্য ও ভূমিকা, নবপর্যায়ে পৃথিবী।আতঙ্কিত হওয়ার মতো যথেষ্ট উপাদান আছে এই সংক্রমণকে কেন্দ্র করে এটা ঠিক। মানুষের সাথে মানুষের সংযোগে ছড়িয়ে পরছে। আজকের দিনে যে সংযোগ এড়িয়ে চলা বিশেষত আমাদের মতো দেশে দুঃসাধ্য। এটায় মৃত্যু হার কম কিন্তু একই ব্যাক্তির পুনঃসংক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল। এই রোগটার ক্ষেত্রে যেটা বড় সমস্যা সেটা হলো এই ভাইরাসটি ইনকিউবিশন পিরিয়ডে আক্রান্ত বিশেষ বুঝতে না পেরে সংক্রমণের মাধ্যম হিসেবে কাজ করতেই থাকে প্রায় পনেরো দিন পর্যন্ত কোন কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশীদিন। ফলে চূড়ান্ত সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং সেটাও ৬/৭সপ্তাহ পর্যন্ত ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। যেহেতু এই নতুন ভাইরাসের জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষেধক এখনো অনাবিস্কৃত।
উল্টোদিকে আমাদের মতো অতি গরীব জনবহুলদেশে এই পদ্ধতি অনুসরন প্রায় অসাধ্য সাধনের সমতুল্য। আর যদিওবা এটা বলপূর্বক কার্যকরী করার চেষ্টা হয় সেটা আরো নতূন ধরনের সমস্যার জন্ম দেবে যা ইতিমধ্যে ই দেখা দিচ্ছে।একই সাথে শুধু যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাই নয় প্রয়োজন রোগ নির্ণয়ের গণ পরীক্ষার। কেরল ও মহারাষ্ট্রে কিছুটা ছাড়া সর্বত্র উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এলেই শুধুমাত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু ভাইরাস ইনকিউবিশনে থাকাকালীন যে রোগীদের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না , কমিউনিটি টেষ্ট ছাড়া তা জানা সম্ভব হচ্ছে না ফলে বিস্ফোরনের আগে পর্যন্ত আমরা জানতেও পারবোনা এটা আমাদের দেশে কি ভয়বহতা নিয়ে অবস্থান করছে। পরীক্ষা হচ্ছে না কারন হয় পরীক্ষাগারের অভাব নচেৎ কিটের অভাব।
একদিকে অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহ মানুষকে ঘরে আটকে রাখার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। একই সাথে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা একধরনের মানসিক হতাশার জন্ম দিতে পারে। দীর্ঘ দিন ঘরে আটকে থাকায় অত্যাবশ্যকিয় পণ্য ও খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ বা ব্যাহত। সমাজে চাহিদা অনুপাতে যোগানের অপ্রতুলতা তৈরী হচ্ছে। অর্থনীতি র চাহিদা যোগানের তত্ত্বানুযায়ী তৈরী হবে বিশাল ঘাটতি। যা পরবর্তী কালে মন্বন্তরের এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে। প্রয়োজনানুযায়ি নির্দিষ্ট দামে খাদ্য সরবরাহের ব্যাবস্থার সরকারি পরিকল্পনার অভাব প্রকট হচ্ছে প্রতিদিন। আসলে এই সরকারগুলি কর্পোরেট সংস্থার অগাধ লুঠের সহায়ক নীতিতে পরিচালিত হবার ফলে গণবন্টন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাগুলিকে দুর্বল করেছে। এখন এই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা এগুলি দেখানর ক্ষেত্রে সামর্থ্য হারিয়েছে। এইগুলিকে চাঙ্গা করে তোলার যথাযথ উদ্যোগের বদলে একের পর এক দিশাহীন সিদ্ধান্ত সরকারের দিক থেকে গ্রহন ও প্রচার করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বয়স্ক ও অপুষ্টিতে ভোগা মানুষই এই রোগে মারা যাচ্ছেন বেশী। বিগত দিনে যদি এই সরকারগুলি এই দেশে খাদ্যের ও পুষ্টির অভাব দূরীকরণে যথাযথ কর্মসূচী গ্রহন করতো তাহলে হয়তো এই রোগের সাথে মোকাবিলা সহজতর হতো।
বর্তমান সময়েও সমস্যার সাথে লড়াইয়ে দিশাহীন সরকার। আমার মনেহয় এক্ষেত্রে উচিৎ ছিলো এলাকার গ্রামসভা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর দের কাজে লাগিয়ে সরকারের সচেতনতা কর্মসূচি কে আরও নিবিঢ় করা,এলাকায় বাইরে থেকে ফেরত আসাদের এলাকার স্কুল বাড়ি অথবা কমিউনিটি হলে কোয়ারাইন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা। একইসাথে এলাকাভিত্তিক বসবাসকারি স্বাধীন প্র্যাকটিশরত আরএমপি ও স্বাস্থ্যকর্মী ডাক্তারদের তালিকা করে ঐ সব মানুষজনের নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ব্যাবস্থা করা যেতে পারতো।এই সরকারগুলির কাজ দেখতে দেখতে মিল্টন ফ্রিডম্যানের মন্তব্য মনে পড়ছে। আসলে যেকোনো সঙ্কট থেকে পরিত্রানের জন্য আমরা সবসময়েই কিছু প্রক্রিয়া গ্রহন করি। এই প্রক্রিয়া গ্রহন প্রধানত নিয়ন্ত্রিত হয় আমরা কোন সঙ্কট এবং কাদের সঙ্কট কাটাতে চাইছি তার দ্বারা। এই সরকারগুলির ইতিহাস এবং সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেশের অবস্থাটাতে চোখ বোলালেই আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এর যথার্থতা খুঁজে নিতে পারব। বিগত বছরগুলিতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ব্যায় বরাদ্দ বৃদ্ধির লাগাতার দাবী সত্তেও ক্রমান্বয়ে এই বরাদ্দ সঙ্কুচিত হয়েছে। যেখান লোন রাইট অফ আর ট্যাক্সে ছাড় দেওয়ার পরিমান প্রায় ৭লক্ষ৮৪হাজার কোটি তখন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যখাতে যৌথ খরচ ১লক্ষ ৮২ হাজার কোটি টাকা। প্রতি ১০১৮৯ জন পিছু ১জন ডাক্তার, ৯০৩৪৩জন পিছু একটি হাসপাতাল তাও প্রয়োজনীয় উপকরন প্রায় নেই। এখনো যখন সংক্রমিতের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়বে তখন এই পরিকাঠামো নিয়ে মৃত্যু মিছিল রুখতে পারবোনা যেনেও এই কর্পোরেট সেবক সরকার বিদেশ থেকে প্রভাবশালী দের সরকারি খরচে বয়ে আনছে আর যাঁদের প্রয়োজন ছিল সাহায্যের তাঁরা হাটতে গিয়ে ২২জন মৃত। জীবিতদের বসিয়ে কীটনাশক স্প্রে করে সংক্রমণ রোধের অমানবিক প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। যা আবার হাস্যস্কর নির্বুদ্ধিতার উদাহরন।স্বাভাবিকবিকভাবেই প্রয়োজন ছিল কঠোর ভাবে লক ডাউন কার্যকরী করা। একইসাথে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যাবস্থা, তাঁদের কোয়ারান্টাইন ও টেষ্টের ব্যাবস্থা করা। সময় অনেকদিন ছিলো। সরকার তখন ব্যাস্ত বিপিসিএল বিএসএনএল,এয়ারইন্ডিয়া সহ এয়ারপোর্টগুলো তাদের কর্পোরেট প্রভুদের ভেট দেবার ব্যাবস্থা করতে। যখন বিপদ দেখা দিতে শুরু করেছে তখন থেকে যথেষ্ট টেষ্টিং কিট তৈরী , মাস্ক, পিপিই ইত্যাদি সংগ্রহে নজর দেওয়া হলে আজকের এই দিন হয়তো আমাদের দেখতে হতো না। তার বদলে এতোদিন বাদে দিশাহারা সরকার কখনো মিষ্টির দোকান খোলার কথা ভাবছে কখনো বা প্যান্ডেল করে করোনা হাসপাতাল তৈরির অবাক করা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। উল্টোদিকে নিজামুদ্দিন মসজিদের মতো ন্যাক্কার জনক ঘটনা খোদ রাজধানীর বুকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নাকের ডগায় ঘটার সুযোগ পাচ্ছে যখন কিনা শাহীনবাগ নিয়ে সক্রিয়তার অভাব হচ্ছে না।যখন এই প্রশ্নগুলো সামনে আনা হচ্ছে তখন মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে বলা হচ্ছে দেশ সঙ্কটে এখন রাজনীতি নয়। সরকারের বশংবদ কিছু বামপন্থী নামধারী বুদ্ধিজীবী ও তাতে গলা মেলাচ্ছেন। কিন্তু এটাই উপযুক্ত সময় যখন সরকারের ব্যার্থতা এবং ভুলনীতি গুলো আবরনের বাইরে প্রকট হয়ে উঠেছে।মৌলিক অধিকার গুলি অর্জনের লড়াই তা আদায় না হওয়া পর্যন্ত কখনই বন্ধ করা যেতে পারেনা। বিশেষত যখন অধিকার হরনের ফল ভুগতে হচ্ছে শ্রমজীবী অংশকেই। এই দাবী তীব্র করা উচিৎ এতোদিন কোটি কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার খালি করে যাদের কোষাগার ভর্তি করতে সাহায্য করেছে তার থেকে বৃহদংশ ফেরত আনতে হবে। ধর্ম প্রতিষ্ঠান গুলির আয়ের একটা অংশ অবশ্যই আদায় করে এই সঙ্কট মোকাবিলায় ব্যবহার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে আমাদের। এই অনুৎপাদক পূঁজি আদায় করে সম্পদসৃষ্টির মূল চালিকা শক্তি শ্রমজীবী অংশকে রক্ষায় কাজে লাগানর দাবি তো এখনই তোলার সময়। প্রয়োজনতো এখনই সর্বাধিক। বিশেষত লকডাউন ছাড়া প্রতিষেধক নেই। আর তা সফল করতে হলে খাদ্য সমস্যার সমাধানের একই সাথে দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য রক্ষার এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী পথ।আবারো মিল্টন ফ্রিডম্যানের কথায় যেতে হয়। “বর্তমান রাজনীতি র বিকল্প গড়ে তোলা তাকে ততক্ষণ জীবিত রাখা ও লালন করা প্রয়োজন, যতোক্ষণ না আজকের রাজনৈতিক ভাবে অসম্ভবটি, রাজনৈতিক ভাবে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে”। এটা পরিলক্ষিত যে প্রত্যেক বিপর্যয়ই একটা নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেয়। হয়তো এই বিপর্যয়ের পরিনতিতে উন্মত্তের মতো সম্পদের কেন্দ্রীয়করনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তাকে নিরস্ত্র হতে বাধ্য করবে। তবে সেটা স্বতঃস্ফুর্তভাবে হবে না। সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে নির্দিষ্ট অভিমুখে চালনার জন্য উদ্যোগী হতে হবে। আর সেই কাজতো বামপন্থীদের কেই দায়িত্ব নিয়ে সম্পাদনে এগিয়ে আসতে হবে।
একটু অন্য দিকের থেকে দেখলে আমরা দেখবো প্রকৃতি নিজের ভারসাম্য ফিরিয়ে এনে আরো কিছুদিনের জন্য নিজেকে রক্ষা করে নিলো। এই দীর্ঘ লকডাউন দূষণের মাত্রা কমিয়ে এনেছে। আকাশ তার নীলিমা ফিরে পেয়েছে,উত্তরমেরুর বরফের গলে যাওয়া কমছে । হিমালয়ে বরফ জমছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা আবার স্বমহিমায় ফিরে আসছে। আর তা প্রকৃতি তার শ্রেষ্ঠ কীর্তির নূন্যতম জীবনের ক্ষতি করেই ফিরে পাচ্ছে। যেখানে ভারতের মতো দেশে প্রতিবছর ১৬লক্ষ লোক মারা যায় চিকিৎসা র অভাবে। চিকিৎসা করাতে না পেরে প্রায় ২৫হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে, বছরে ৪লক্ষ৮০হাজার শিশু জন্মের এক বছরের মধ্যে অপুষ্টির কারনে মারা যায় সেখানে সারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ হাজার জীবনের বিনিময়ে এতোসব ফিরে আসছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের বহু সতর্কবার্তা সত্তেও কর্পোরেট দূনিয়া জঙ্গল জ্বালানো বা জঙ্গলের গাছ কেটে মাটির তলার সম্পদ লূঠের মতো কাজ করে চলেছিল নির্বিকার ভাবে। এটা বোধ হয় প্রকৃতির সেই ঈঙ্গিত প্রত্যাঘাত করো। মানুষের আগামী প্রজন্মের বসবাসের উপযুক্ত পৃথিবীর স্বার্থে তীব্র আঘাত হানো।
উত্তরপ্রদেশ সরকার বাড়ি ফেরা শ্রমিকদের উপর অমানবিক ভাবে রাসায়নিক স্প্রে করছে। পাল্টা আক্রান্ত শ্রমিক ঘুরিয়ে দিক তাঁর তীব্র ঘৃণা। সংগঠিত হোক তাঁরা। দায়িত্ব তো তাঁদেরই নিতে হবে যাঁরা সব বিপদে মানুষের পাশে রাস্তায় আছেন। এখনো রক্তের প্রয়োজনে যাঁরা নিজের ধমনীতে সূঁচ ফুটিয়ে রক্ত দিতে দ্বিধা করে না। লকডাউনের মধ্যে অসহায় মানুষের ওষুধ খাবার যাঁরা পৌছে দিতে নিজেদের বিপদ অগ্রাহ্য করে। তাঁদের কেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।কৃতজ্ঞতা স্বীকার ডাঃসমুদ্র সেনগুপ্ত, বিদ্যুত গুছাইত, পুরন্দর ভাট, দেবোত্তম চক্রবর্তী, চারুদত্ত নীহারিকা রজত(রজত চক্রবর্তী) ও আরো কয়েকজন।