চিন্তন নিউজ:২৫শে জুন:- নিমাই ভট্টাচার্যের মৃত্যুর সাথে সাথে বাংলা সাহিত্যে দেশভাগের ক্ষত কে ধারণ করে, সেই যন্ত্রণাকে সাহিত্যে খোদাই করার প্রজন্মের এক শিল্প সৃষ্টির যুগের অবসান হল। তিনি প্রবাসী জীবনের কান্নাহাসির দোলদোলানো পৌষ ফাগুনের মেলার সঙ্গে আপামর বাঙালির আত্মিক সংযোগের এক সেতু ছিলেন।
অবিভক্ত যশোহর জেলার মাগুড়ার শালিখা গ্রামের সন্তান ছিলেন নিমাই ভট্টাচার্য। সারা জীবন বুকের ভিতর পরম যত্নে লালন করেছিলেন অখন্ড বাঙালির চিন্তা-চেতনা ধারাকে। বগুড়ার জামাই বলতে তিনি গর্ববোধ করতেন। ছিন্নমূল বাঙালির হাজারো ক্লিন্নতাকে অতিক্রম করে তাঁদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াইকে চিরদিন সেলুট করে আজ চিরবিদায় নিলেন নিমাই ভট্টাচার্য। বাংলা সাহিত্যে প্রবাসী জীবন এবং প্রবাসী সংস্কৃতির ভেতর বাঙালির আত্মপরিচয় খুঁজে নেওয়ার বারোমাস্যা নির্মাণে, নিমাই ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যাযাবর বিনয় মুখার্জি এবং তাঁর সৃষ্টি ‘দৃষ্টিপাতে’র মতোই অমর হয়ে থাকবেন।
প্রবাসী জীবনে শেকড়ের টান অনুসন্ধানে আত্মনিবেদিত স্রষ্টা যাযাবর আর নিমাই ভট্টাচার্যের মত খুব বেশি মানুষ নেই।পেশাগত কারণে প্রবাস জীবন কে তাঁর যাপন চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে, সদ্য বিভাজিত ছিন্নমূল মানুষদের বেঁচে থাকার লড়াই, সেই লড়াই কে প্রতিষ্ঠা করার যে হাজারো রকমের গলি থেকে রাজপথের বিচরণ, তার অসামান্য ধারাভাষ্য রেখেছেন নিমাই ভট্টাচার্য।
উচ্চবিত্তের সংকটকে যেমন দেখিয়েছেন । এই সঙ্কটের প্রতিবিম্ব নির্মাণে সমরেশ বসুর ‘ প্রজাপতি’ র ‘ রুবি দত্তে’ রা যেন নানা ভাবে ভিড় জমিয়েছেন নিমাইয়ের সৃষ্টিতে। সমরেশ যেমন রুবি দত্তের ভিতর ভালগারিটি খুঁজতে চান নি নিজের বইকে বেস্ট সেলার করতে, তেমনটাই ছিল কিন্তু নিমাই ভট্টাচার্যের সৃষ্টির অভিব্যক্তি ও। তফাত একটাই সমরেশের সৃষ্টিকে নেশাদার মঞ্চে আনতে পেশাদার লোকেরা সেখানে মশলা সংযুক্ত করেছেন। আর পেশাদার লোকেদের আর্থিক সাফল্যের তাগিদে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোপে পড়তে হয়েছে সমরেশকে। এমন দুর্যোগ অবশ্য নিমাই ভট্টাচার্যের জীবনে না এলেও, আঁতলামি করেন নি বলে সমালোচক মহলের তাঁকে ঘিরে তেমন ঔৎসুক্যও ছিল না। যদিও নিমাই ভট্টাচার্য সারাজীবন এসবের তোয়াক্কাও করেন নি।
এক ধরনের নিস্পৃহ, অথচ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর দিয়ে তিনি মধ্যবিত্তের সংকটকে উপস্থাপন করেছেন। এই উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ,নিজের শ্রেণী চেতনার মধ্যবিত্ত জনিত ভাবাবেগকে কখনো অস্বীকার করেননি নিমাই ভট্টাচার্য ।তাঁর বহুল পঠিত এবং বহুল পরিচিত উপন্যাস ‘মেম সাহেব ‘ ,যেমন সমকালীন ঘনায়মান জীবনের এক অতুলনীয় ধারাভাষ্য , তেমনিই এই উপন্যাসটিকে যদি , আজকে , নিমাইবাবুর চিরবিদায়ের সন্ধ্যেতে আমরা পড়ি, তাহলেও কিন্তু আমাদের মনে হবে যে; এই উপন্যাসটি বোধহয় লেখক গতকাল শেষ করেছেন। অর্থাৎ; এই ‘ মেমসাহেব’ উপন্যাসের ভেতর সমকালীনতাকে তিনি যে ভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন , তা মনে হয়, যে কোনো সময় , যে কোনো প্রেক্ষিতে, পাঠকের কাছে ,তাঁকে অত্যন্ত বেশি রকমের আধুনিক একটি আজকের দিনের একটি জীবন যৌবনের লড়াইয়ের গীতিকবিতা বলে মনে হবে। প্রবাসী জীবনকে সাহিত্যের মধ্যে নিয়ে এসে ,প্রবাসী জীবনের সংকটকে উপস্থাপিত করতে গিয়ে , যে বাংলার জনজীবনের কোন নিত্যনৈমিত্তিক প্রেক্ষিতকে তিনি অস্বীকার করেছেন, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই ।’ মিনিবাস’, ‘ ইনকিলাব’ , ‘ মাতাল’ ,’ ব্যাচেলার ‘ ইত্যাদি সহ তাঁর অন্যান্য বহু লেখা পড়লে মনে হয়, কে বললে এই মানুষটি প্রবাসী জীবনযাপন করেন ? আজ যেমন কলকাতার রানিকুঠিতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন , তেমনিই মনে হবে , এই মানুষটি আজন্ম ,এই বাংলার আলো -বাতাস- জল- আগুনের ভেতর দিয়েই ,নিজের জীবন ,নিজের চর্চা, নিজের দৈনন্দিন ভালোলাগা ,বিরক্তি ক্ষোভ –সমস্ত কিছুকে উপলব্ধি করে , সেই দৃষ্টিভঙ্গির একটা নির্যাস ,তাঁর সৃষ্টির মধ্যে রেখে গেছেন।
নিমাই ভটচাজ এমন একজন সাহিত্যিক, যাঁকে কখনো বাঙালি অনুপস্থিত সাহিত্যিক বলে মনে করতেন না । আবার সেই উপস্থিতির বাধ্যবাধকতায় , তিনি জোর করে কোন আরোপিত বিষয় চাপিয়ে দিচ্ছেন পাঠকদের ভেতরে – তা কিন্তু নয়। তাঁর সৃষ্টির ভেতর কোন সমাজ মনষ্কতা নেই– এমনটাও কিন্তু ঘটেনি ।
এই পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি যখন বাংলা সাহিত্যের বর্তমান প্রেক্ষিতে ক্রমশ দুর্লভ হয়ে পড়ছে , সেই রকম পরিস্থিতির ভেতরে দাঁড়িয়ে, সংকট এবং সংকট থেকে উত্তরণের জন্য লড়াই ই যে একমাত্র পথ ,আর সেই লড়াই করতে গেলে যে ,কোন একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক পতাকা ধরে লড়াই করতে হবে ,তা নয় ;একেবারে ঘরের মধ্যে থেকে ,নিজস্ব যাপন চিত্রকে অবলম্বন করে, কিন্তু আদর্শে স্থির থেকে, লড়াই করলেই যে অচলায়তন ভাঙ্গা সম্ভব– এটা নিমাই ভট্টাচার্য তাঁর জীবন এবং তাঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে অত্যন্ত জোরে সঙ্গে দেখিয়ে গেলেন।
নিমাই ভট্টাচার্য খুব বেশি লেখেননি । আবার খুব কমও লেখেন নি। কিন্তু নিমাই ভট্টাচার্য বাজার চাহিদার উপর নির্ভর করে , নিজের সৃষ্টিকে পরিচালিত করেছেন- এমন অভিযোগ কোন অবস্থাতেই তাঁর সম্পর্কে বলা যায় না ।সাবলীল মনের ভেতর একটা অদ্ভুত ধরনের আবেশ তৈরি করে ,পাঠক কে দিয়ে পড়িয়ে নেওয়া –এটা ছিল কিন্তু নিমাই ভট্টাচার্যের সামগ্রিক সৃষ্টির একটা বিশেষ রকমের বৈশিষ্ট্য।
এক্সপেরিমেন্টের নাম করে হাজারো ধরনের দুর্বোধ্যতা তৈরি করে, শব্দের নানা রকমের আঁকি বুকির ভেতর দিয়ে ,নিজেকে অত্যন্ত একজন পন্ডিত দেখানো এটা নিমাই ভট্টাচার্য্য একটিবারের জন্য বিশ্বাস করতেন না।তাই তাঁর লেখায় কখনো দুর্বোধ্যতা নেই। আবার সরলীকরণ ও নেই ।সেই কারণে একজন অত্যন্ত বিদগ্ধ পাঠকের কাছেও যেমন তিনি সমাদৃত ,আবার অতি সাধারণ গৃহবধু থেকে শুরু করে, প্রথাগত শিক্ষার বেশি সুযোগ না পাওয়া মানুষের কাছে তিনি সমান সমাদৃত ।
বাঙালির চিন্তা-চেতনার প্রদীপের সলতে কে উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিমাই ভট্টাচার্য তাঁর গোটা জীবনের সাহিত্য সৃষ্টিতে পরিচালিত করে গিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি নিয়ে উত্তম কুমার অপর্ণা সেনের অভিনীত ফিল্ম ‘ এক ই নামে’ যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।তাই বলে নিছক বিনোদন সৃষ্টির তাগিদে কিন্তু কলমকে কখনো ব্যবহার করেননি নিমাই ভট্টাচার্য।
কলমের ভেতর দিয়ে সমাজকে , সংস্কৃতিকে , মানুষকে সভ্যতা কে , একটা সুনির্দিষ্ট বার্তা দেওয়ার চেষ্টা- নিমাই ভট্টাচার্যের সৃষ্টির সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য । এই বৈশিষ্ট্যের ভেতর মূর্ত হয়ে উঠেছে মানুষের লড়াই য়ের বিষয়টি। মানুষের আত্ম মর্যাদার বিষয়টি । সার্বিকভাবে ভালোবাসা ,ভালোলাগার বিষয়টি। নিমাই ভট্টাচার্যের পরিণত বয়সে মৃত্যু সামগ্রিকভাবে বাংলা সাহিত্যের সিরিয়াস সাহিত্যিকের অভাব টাকে একটু দীর্ঘ করবে।