কলমের খোঁচা

নজরুল ইসলাম ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র


মিতা দত্ত: চিন্তন নিউজ:২৫শে মে:- “আমি সেই দিন হব শান্ত/
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাস ধ্বনিবে না —/
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপান ভীম রণভূমে রনিবে না—/
বিদ্রোহী রণক্লান্ত/
আমি সেই দিন হব শান্ত।”
কাজী নজরুল ইসলাম।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি নিরন্তর অন্বেষণ, অনুশীলন ও জিজ্ঞাসার দ্বারা জারিত হতেন। তিনি জগৎ ও জীবনের অন্তর্গত গূঢ় ব্যাখ্যা উদ্ঘাটনে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন। বিরাজমান অবস্থা ও ব্যবস্থাকে বদলানো তাঁর জীবনের ব্রত ছিল।সেই ব্রত পালনে তিনি নতজানু হয়েছেন ইতিহাসের কাছে। তিনি ইতিহাসকে ধারণ, বহণ ও প্রচার করতেন। তিনি তাঁর লেখায় শব্দের সঙ্গে শব্দ ঘষে আগুন জ্বালাতেন। তাই তো তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধায় অভিহিত। তাঁর বিদ্রোহ ছিল পরাধীনতা, অপশক্তি, অন্যায়, অনাচার, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, একদিকে কঠোর দারিদ্র্য ও অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরদের ব্যাঙ্কে জমছে রাশি রাশি অর্থ। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে একদিকে লেখনি ধারণ করেছেন, অন্যদিকে তাঁর কাজকর্মের দ্বারা বৈষম্য দূর করার চেষ্টা করে গিয়েছেন।

সাহিত্য সৃষ্টির সর্বক্ষেত্রেই ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এছাড়াও চলচ্চিত্র জগতেও তাঁর আনাগোনা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তিনি বাঙালিকে নজরুলগীতি, গজল ও শ্যামাসঙ্গীত উপহার দিয়েছেন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, তা নতুন প্রজন্মের পত্রিকা সম্পাদকদের কাছে শিক্ষণীয়।

তাঁর যাপিত জীবনের মধ্যেই বিদ্রোহের বীজ প্রোথিত ছিল।পারিবারিক সমস্যার কারণে অ্যাকাডেমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সেভাবে পাননি। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। মক্তবে প্রাথ‌মিক শিক্ষা দিয়ে জীবন শুরু হলেও পিতার অকালমৃত্যু তাঁর জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়। শুরু হয় তাঁর জীবনসংগ্রাম। পরিবারের আর্থিক অনটন দূর করার জন্য মসজিদ দেখাশোনার দায়িত্ব নেন তিনি। এই কাজে আগ্রহ না পাওয়ায় ও স্বভাব কবি হওয়ায় নিকট আত্মীয়ের হাত ধরে তিনি তৎকালীন গ্রামীণ সংস্কৃতি লোটোগানের দলে যোগ দেন ও দলের প্রয়োজনে লেখালিখি শুরু করেন। লোটোগানের দলের সাথে বিভিন্ন গ্রামে পরিভ্রমণের সূত্রে তিনি শ্রমজীবী মানুষের লড়াই খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেন। সেই লড়ায়ের সঙ্গে তিনি জড়িত ও জারিত হন। প্রয়োজনে তিনি রুটির দোকানে কাজ করেন। তারপর কিছুদিন বিদ্যালয়ের সংস্পর্শে এলেও চোদ্দো বছরে বয়সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেন ও ব্রিটিশ শাসককে খুব কাছ থেকে দেখেন।সেই সময় থেকেই জোরালো ভাবে ব্রিটিশ বিরোধিতার বীজ তাঁর অন্তরে প্রোথিত হয়। তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে গান রচনা ও গান গাওয়ার মাধ্যমে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন ।

এইসময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী মুজাফফর আহমেদের সংস্পর্শে আসেন ও মার্ক্সবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি নিজেকে কোনো দেশের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। শুরু হয় তাঁর সাহিত্যিক জীবন ও একই সাথে পত্রিকা সম্পাদনার কাজ।বাংলা সাহিত্যে তাঁর আর্বিভাব উল্কার মতো। মাত্র বাইশ বছর তাঁর সাহিত্য ও শিল্পের জীবন। তাতেই তিনি চিরভাস্বর হয়ে আছেন। সেই সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। অবশ্য শৈশবকাল থেকেই তিনি রবীন্দ্রভক্ত। মুজফফর আহমেদের ভাষ্য অনুষায়ী, বন্ধুরা তাঁকে বলত ‘রবীন্দ্রনাথের হাফিজ’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে খুব স্নেহ করতেন এবং তাঁর সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাঁকে সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহ দিতেন। এই সখ্যতা আমৃত্যু অব্যাহত ছিল।

নজরুল তৎকালীন এক শ্রেণির কবির রবীন্দ্রবিরোধিতা ও ‘জ্ঞান ভার্ষিক’ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মুখর ছিলেন। জ্ঞান ভার্ষিক কথার অর্থ যারা দেশজ সংস্কৃতি ভুলে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ করতেন ও অযাচিতভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আক্রমণ করতেন তাঁরা। তিনি উপল‌দ্ধি করেছিলেন, এই প্রজাতির কবিরা বাংলা সাহিত্যের পক্ষে বিপদজনক। তাই কঠোর ভাবে তাঁদের কাজের প্রতিবাদ করেন তিনি।

তাঁর উপনিবেশিকতা বিরোধী অরগ্যানিক কণ্ঠস্বর গমগম করত। এই আঁচ পাওয়া যায় তাঁর লেখনিতে। তাঁর সম্পাদিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় তিনি শোষণমুক্ত নতুন যুগের কথা বলেছেন। তিনি মানুষ বর্গটিকে বিশেষিত করেন শ্রেণি অর্থে। তিনি ব্যবহার করেন শোষিত হিসাবে কৃষক, শ্রমিক, বর্ণবাদে আক্রান্ত নিম্ন বর্গের মানুষ ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নানাভাবে প্রলেতারিয়েত হয়ে থাকা নারীদেরকে চিহ্নিত করেছেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল হওয়ায় প্রলেতারিয়েত কথাটি ব্যবহার করেছেন তিনি।

নজরুল সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় ভারতবর্ষের প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলা হয়। তিনি বলেন, “আমি স্বরাজ বুঝি না। ওটার মানে একেক জন একেক রকম করে থাকেন।” ব্রিটিশ শাসনমুক্ত ভারতবর্ষের কথা লিখিত হয় তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায়। সেই সাহস সেই সময় অন্য কেউ দেখায়নি। ‘ধুমকেতু’ পত্রিকাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্শীবাদ করে লিখেছিলেন, “আয় চলে আয়রে ধুমকেতু আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দূর্দিনে এই দূর্গশিরে, উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন”।পত্রিকার পাতার ঠিক ওপরে এই বাণীটি লেখা থাকত।

১৯২২ সালে ২৬শে সেপ্টেম্বর নজরুলের কবিতা “আনন্দময়ীর আগমন” প্রকাশিত হয়। এটিতে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ায় ব্রিটিশ সরকারকে এতোটাই প্রভাবিত করে যে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে। ১৯২৩ সালের ৭ ই জানুয়ারি বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে জবানবন্দি প্রদান করেন। তাঁর এই জবানবন্দী বাংলা সাহিত্যে “রাজবন্দীর জবানবন্দী” নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা পেয়েছে।

বিচারের রায়ে তিনি একবছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন। জেল ফেরত তিনি আবার পত্রিকা সম্পাদনার কাজে নিজেকে সমর্পণ করেন। সঙ্গে চলতে থাকে লেখালেখি।

‘লাঙল’ ছিল শ্রমিক প্রজা স্বরাজ সম্প্রদায় নামে শ্রমিক শ্রেণীর একটি সংগঠনের মুখপত্র। সাপ্তাহিক পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হত। পত্রিকা প্রচ্ছদে থাকত কাঁধে লাঙ্গলবাহী একটি কৃষক। লাঙলের প্রথম সংখ্যার মূল আকর্ষণ সাম্যবাদী শিরোনামে এগারোটি কবিতার সমাহার। তিনি এই পত্রিকায় কার্লমাক্সকে ঋষি বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি জগৎ পাল্টানোর কথা ভেবেছেন। বিদ্রোহী পত্রিকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাঁর এই মানসিকতার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। তিনিই প্রথম কবি যার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ বা বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

মুর্শিদাবাদ জেলার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিন হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন তিনি। তার মধ্যে আছে নজরুল গীতি, গজল ও শ্যামাসঙ্গীত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তিন দিকপাল— লালবাগের কাদের বক্স, মস্তান গামা ও সৈয়দ আনোয়ার আলি মির্জা (মঞ্জু)-র কাছে নজরুল ইসলাম সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। তাঁর গানের প্রথম স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশ করেন এ জেলার নিমতিতার নলিনীকান্ত সরকার। ‘নজরুলগীতির ভগীরথ’ বলা হয় কবির আর এক বন্ধু, বহরমপুর শহরের কাদাই ভট্টাচার্য পাড়ার প্রখ্যাত গায়ক উমাপদ ভট্টাচার্য (ফেনু)-কে। নজরুলগীতির প্রসারে ফেনুর অবদান অসামান্য। আবার ফেনুবাবুর দুই কন্যার সঙ্গীতগুরুও ছিলেন নজরুল।

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভরসাস্থল ছিলেন বহরমপুর শহরের প্রখ্যাত আইনজীবী শশাঙ্কশেখর সান্যাল। সুগায়ক শশাঙ্কশেখর আবার উমাপদবাবুর পিসতুতো ভাই। ১৯২৫ সালে কলকাতায় মহাত্মা গাঁধীর উপস্থিতিতে নজরুল শশাঙ্ককে দিয়ে দুটি গান— ‘চরকার গান’ ও ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গাওয়ান। বহরমপুর জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানটি লিখেছিলেন নজরুল। জেল থেকে ছাড়া পেলে কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্ররা ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর নজরুলকে ফুলমালায় সাজিয়ে, সম্বর্ধনা দিয়ে বহরমপুর শহর পরিক্রমা করেছিলেন।

‘নজরুল স্বরলিপি’ গ্রন্থটি কবি উমাপদ ভট্টাচার্যকে উৎসর্গ করেন। লালগোলার সাধক বরদাচরণ মজুমদার ছিলেন কবির যোগগুরু।

মনে প্রাণে বিপ্লবী নজরুল ১৯৪২ সালে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে জীবনের মতো বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। সত্যিই যন্ত্রণাদায়ক সেই ঘটনা। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হন তিনি তাঁর জীবন দিয়ে যে জীবনবোধ শিখিয়েছেন, তা সংগ্রামী মানুষের আজও পাথেয়।

করোনা ভাইরাস জনিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র যেভাবে শ্রমজীবী মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তাতে বেশি করে তাঁকে মনে করাচ্ছে।স্বাধীনতার পরেও জনতার ক্রন্দনরোল আকাশবাতাস ধ্বনিত করছে। তাই এই স্বাধীনতা নয়, মুক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। তবেই তাঁকে স্মরণের স্বার্থকতা।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।