কলমের খোঁচা

সামাজিক মাধ্যমে নাস্তিকতার প্রচার কেমন করে, কোন্ ভাষায়?


নিজস্ব প্রতিবেদনে অরূপ সেনগুপ্ত: চিন্তন নিউজ:২৯শে সেপ্টেম্বর:– কোনো বরেণ্য মার্কসবাদী নেতৃত্ব বিদ্যা তথা বিজ্ঞানসাধনার সংস্থানে কোনো সম্প্রদায়ের দেবমূর্তির প্রকাশ্য উপস্থিতি নিয়ে যা বলেছেন, এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে অন্ততঃ সমাজমাধ্যমে গরিষ্ঠাংশের যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে, সেই প্রসঙ্গেই এই কথা।

কোনো মার্কসবাদী রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষে সংগ্রামের সাথী মানুষদের মনের জানালায় যোগাযোগ করতে গিয়ে, তাঁদের সচেতন করতে গিয়ে একদিকে তাঁর নিজের ভাব আর ভাষা, আর অন্যদিকে ওই মানুষদের চিরন্তন অভ্যাস-সংস্কার-ভাবধারার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা একান্ত দরকার; না হলে বক্তব্য ঠিকই বলা হবে, কিন্তু যাঁর ওপরে ওই বক্তব্যের যা অভিঘাত কাম্য ছিলো, তা তো হবেই না, উলটে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে।

আর অবশ্যই, নিন্দা-ট্রোলিং-কটুকাটব্যের ঝড় উঠবে; আর স্থিতস্বার্থের মানুষেরা সেই প্রতিক্রিয়াকে উসকে দেবে। আর আসল বক্তব্যটা চাপা পড়ে যাবে…

কিন্তু প্রশ্ন ওঠে মূলতঃ দুটি-

(১) মূল কথাটি অবশ্যই ঠিকঃ
প্রথমেই প্রশ্ন হওয়া দরকার- মূল বক্তব্যটি কোনো বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের ভাবাবেগকে আঘাত করেছে, মেনে নিয়ে এবং তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়েও (বক্তা নন), মূল বক্তব্যটিকে কি ভুল প্রমাণ করা সম্ভব? যে কোনো ধর্মপ্রাণ হিন্দু অবশ্যই দেবী সরস্বতীর পূজা করতে পারেন, তাঁকে শ্রদ্ধা করতে পারেন, তাঁকে নিজের বিশ্বাসমতে ভারতীয় সংস্কৃতির ‘সনাতন’ (দেবী সরস্বতী আদিতে নদীমাতৃকা, পরে বচন ও সঙ্গীতের দেবী আর আরও পরে শক্তি, বিদ্যা, জ্ঞান ও বিবিধ চারুকলার দেবীতে বিবর্তিতা হয়েছেন; মহাসরস্বতী, নীলসরস্বতী বা মহাবিদ্যা তারা, ব্রাহ্মণী, ভারদী, গায়ত্রী, সাবিত্রী ইত্যাদি) অংশ মনে করতে পারেন; সেটা একদিকে যেমন তাঁর সাংবিধানিক অধিকার, অপরদিকে তাঁর চিরন্তন চিন্তন, সংস্কার আর আবেগের আধার- তাকে সম্মান জানাতেই হবে। কিন্তু তারপরে? একে বস্তুবাদ (মেটেরিয়ালিজম) বলবেন কি উপযোগবাদ (প্র্যাগম্যাটিজম) বলবেন আপনাদের বিষয়। কিন্তু শুধু দেবীর পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে (আমার ধর্মীয় আবেগ চরিতার্থ করে), কোনো পঠনপাঠন না করে (প্রকৃত অর্থে চক্ষু-কর্ণ আদি ইন্দ্রিয়ানুভূতির মাধ্যমে পাঠ গ্রহণ না করে, তাকে চিন্তন-বিচার-বিশ্লেষণ আদি বৌদ্ধিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আয়ত্ত্ব না করে, সুসংবদ্ধ জ্ঞানে পরিণত না করে আর কথন-লিখন-অংকন আদি প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ না করে) বাস্তবে কি পড়া তৈরি করা, পরীক্ষায় পাশ করা, চাকুরি বা ব্যবসায় করা অথবা বিজ্ঞান সাধনা করা (ডাক্তারি করা, বাড়ি-ব্রিজ বানানো, কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করা, ওষুধের গুণমান পরীক্ষা করা, আকাশে প্লেন কি রকেট পাঠানো)- একটা কোনো কাজও কি সম্ভব? কেউ কি নিজের সন্তানের জীবনে এই আধ্যাত্মিক সিদ্ধান্ত নেবেন? মাথায় করে রাখবো।

(২) আমার অধিকার রয়েছে নাস্তিক হবার, নাস্তিকতার প্রচার করারঃ
দ্বিতীয় প্রশ্নটি সাংবিধানিক। ভারতের সংবিধানের ২৫ থেকে ২৮ ধারায় ভারতের নাগরিকদের ধর্মাচরণ ও আনুষঙ্গিক অধিকার ও সেই সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বলা রয়েছে। তার মধ্যে প্রাসঙ্গিক ২৫ নং ধারা, যেখানে নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসরণ ও তার আচার-অনুষ্ঠান ব্যষ্টি বা সমষ্টিতে পালনের অধিকার উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ১নং উপধারায় বলা হয়েছে, Subject to public order, morality and health and to the other provisions of this Part, all persons are equally entitled to freedom of conscience and the right freely to profess, practise and propagate religion- যার মধ্যাংশটিতে স্পষ্টভাষায় নিশ্চিত করা হয়েছে- প্রতি নাগরিকের অধিকার রয়েছে তাঁর বিচারবোধ (conscience) অনুসরণ করবার, এবং, অবশ্যই, তাঁর পছন্দের ধর্ম নির্বাচন, তার আচার অনুষ্ঠানাদি পালন, আর (সর্বনাশ!) সেই ধর্ম বিস্তার (propagate) করার। লক্ষ্যণীয়, এখানে ধর্ম বলতে ঈশ্বর-বিশ্বাসী ধর্মের কথাই বলা হয়েছে, বিশ্বাস অথবা পালনীয় বা আচরণীয় সংস্কৃতি হিসাবে নাস্তিকতার উল্লেখ নেই, থাকা সম্ভবও ছিলো না। কিন্তু পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিরোধের আইনি মীমাংসার পরিপ্রেক্ষিতে একাধিকবার ভারতীয় ন্যায়ালয় তাঁর রায়সমূহে স্পষ্টভাষায় সুচিন্তিত মত প্রকাশ করে বলেছেন- মর্যাদা দিতে হবে ওই entitled to freedom of conscience, কি না বিচারবোধ অনুসরণ করবার অধিকারকে, যেখানে আমার বিচার অনুসারে আমি যেমন নিজের পছন্দের ধর্ম অনুসরণ করতে পারি, ঠিক তেমনই পারি আমার বিচারবোধ অনুসরণ করে নাস্তিকতাকে বেছে নিতে।নাস্তিকতা অনুসরণ করা আমার সাংবিধানিক অধিকার, নাস্তিকতা প্রচার করাও আমার সাংবিধানিক অধিকার, এবং অবশ্যই অপরের অনুরূপ স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ না করে তাঁর ভাবাবেগে আঘাত না করে। কেউ সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে আসলে তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করছেন।
২০১৮ সালের দুইটি মামলায়, যথাক্রমে নওতেজ সিং জোহার বনাম ভারত রাষ্ট্র, আর কে এস পুট্টাস্বামী বনাম ভারত রাষ্ট্র- বিচারপতি স্পষ্ট ভাষাতেই ব্যক্তি বিশেষের নিজস্ব বিচারবোধ, এমন কি তা যদি নাস্তিকতাও হয়, তা অনুসরণের অধিকারের পক্ষে মত দিয়েছেন।

এখানে ভাষার কিছু তারতম্য খেয়াল রাখতে হবে- ভারতীয় দার্শনিক আলাপ আলোচনায় নাস্তিক্যবাদ প্রকৃত অর্থে আধুনিক নিরীশ্বরবাদ নয়; বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক আর চার্বাক- এই চারটি মতবাদ বেদের ঐশ্বরিক মর্যাদা অস্বীকার করে, বেদ অপৌরুষেয় মানে কোনো মানুষের লেখা নয়, এই কথা মানে না, তা ছাড়া এই সকল মতবাদে পরম চেতনা, কর্মফল, পরজন্ম, নির্বাণ- এ সবই স্বীকার করা হয়। আমাদের আলোচ্য ভারতীয় নাস্তিক নন, নিরীশ্বরবাদীরা।
২০১১ সালের জনগণনার তথ্য বলে, ভারতে ১৩% নাগরিক কোনো ধর্মীয় আচার পালন করেন না; এঁদের মধ্যে ৩% ঘোষিত নিরীশ্বরবাদী। মোট সংখ্যা হিসেবে কম নয়!

বিরোধিতা কেন?

প্রকাশ্য মঞ্চে কেউ ধর্মীয় সংস্কার বিরোধী কোনো বক্তব্য পেশ করলে সাধারণভাবে দুই ধরনের মানুষ তার বিরোধিতা করেন- ধর্মপ্রাণ মানুষ আর রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক দুষ্টবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ।

আর, মানুষের জীবনে ধর্ম তো তার উৎপত্তিকাল থেকে এই দুইটি ভূমিকাই পালন করে এসেছে- ধারক এবং সংহারক…..

সুদূর অতীতে সেই সংগ্রাহক-শিকারী-পশুপালক মানুষ থেকে, প্রাচীন কৃষিজীবী মানুষ থেকে এমনকি আজও, দলিত হতদরিদ্র আর প্রকৃত শিক্ষা-বঞ্চিত মানুষ, প্রকৃতি আর সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ বঞ্চিত মানুষ তার শতেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক আর সামাজিক দুরবস্থার কারণ প্রাকৃতিক ঘটনাবলি বা সামাজিক বঞ্চনার মধ্যে খোঁজে না, কারণ হিসেবে মেনে নেয় কোনো অলৌকিক চিন্ময় সত্ত্বা- নানা কিসিমের ঈশ্বর, এবং বাস্তব জীবনে তার কোনো প্রতিনিধি, রাজা, পুরোহিত, সামাজিক নেতা- তার রোষ, ইচ্ছা বা লীলাকে।এবং সেই দুর্দশার প্রতিকার হিসেবে কোনো প্রকৃতিবিজ্ঞান বা সামাজিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোগ নেয় না, বা নিলেও তার গুরুত্ব থাকে গৌণ, বদলে সেই ঈশ্বর বা তার প্রতিনিধির পূজা-সেবার মাধ্যমে তার দয়া-দাক্ষিণ্য অর্জন করাই হয় কাজ। ধর্ম এখানে দুর্বিপাকে সয়ে নেবার, টিঁকে থাকবার মেরুদণ্ড, বিশ্বাস-ভরসার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, আর আশ্চর্য, সেই আদিম সমাজে সকল মানুষের একত্রে টিঁকে থাকার লড়াইয়ের মানবিক গুণগুলি- সহমর্মিতা, সমবেদনা, সহযোগিতা, সততা- এগুলির শিক্ষা দেয়। আবার কখনো বা ওই ধর্মই তাকে মাথা উঁচিয়ে অন্যায়ের অসাম্যের বিরোধিতা করতে শিখিয়েছে, শক্তি দিয়েছে দলিতের নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াবার।ধর্ম এখানে ধারক।
উগ্র ধর্মবিরোধী বক্তব্য এঁদের সেই মেরুদণ্ডে আঘাত করে, তাঁদের জগৎটা আঁধার করে দেয়। এঁরা তাই তীব্র হতাশ্বাসে বিরোধিতা করেন। এঁদের ভুল বুঝবেন না- জগতের নিয়ম এঁদের কাছে স্পষ্ট হলে, জ্ঞানের আলোকে সমাজের বঞ্চনাটা প্রকট হয়ে পড়লে, এঁরা নবচেতনায় জেগে ওঠেন, দ্রুত সত্যকে গ্রহণ করেন।

আর সমাজের আরেক অংশের মানুষ, সমাজের বিত্তবান পরগাছা শ্রেণি, যাঁরা আদিম কৃষিজীবী সমাজের দিন থেকে অপরের শ্রমের উদবৃত্তটুকু আত্মস্থ করতে ব্যস্ত, তাঁদের হাতে ধর্ম মানবতার বিরোধী অস্ত্র। তাঁদের ভাষ্যে ধর্ম শাসককে শোষককে ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে দণ্ডদাতা প্রভু হিসেবে অপরকে পদতলে নত করে রাখার অধিকার দেয়, অপরের উদবৃত্ত শোষণের অধিকার দেয়। তাঁদের ধর্ম সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে প্রীতি আর মিলনের পরিবর্তে বিদ্বেষ আর বিভেদ-বিরোধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়- যেন শোষণ আর বঞ্চনার প্রতিবাদে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। তাঁদের ধর্ম সংহারক।
ধর্মবিরোধী বক্তব্য এঁদের সেই স্বার্থচেতনায় আঘাত করে। তাই সর্বস্তরের প্রতিভুদের একত্র করে এঁরা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেন- যার ভিত্তি ধর্মীয় বিদ্বেষ, যার ভিত্তি রাজনৈতিক অপপ্রচার, আর কুৎসা। এরই প্রকাশ আমরা দেখেছি, যখন বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বিজ্ঞান সংস্থার প্রবেশদ্বারে দেবীমূর্তির উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

আমাদের তো একটা অবস্থান নিতেই হয়, ‘নিরপেক্ষ’ থাকা যায় না কি? নিজের বিবেকবুদ্ধিকে প্রশ্ন করতে হয় তো, Which side are you on, my friend, which side are you on? সিদ্ধান্ত আমার আপনার নিজের।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।