চিন্তন নিউজ, বিশেষ প্রতিবেদন, কল্পনা গুপ্ত, ১২ই জানুয়ারি, ২০২২ – পত্রসাহিত্য সাহিত্যের এক বিশেষ অংশ যার মধ্যে দিয়ে ব্যক্তির মনভাব ও সংস্কৃতির পরিচয় মেলে। বাংলা পত্রসাহিত্যে স্বামী বিবেকানন্দের পত্র এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের ন্যায় বিরাজমান। স্বদেশপ্রেমিক ও মানবপ্রেমিক স্বামীজীর হৃদয় উন্মুক্ত করা আহবান মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, অগ্নিময়ী জ্বালা ধরানো তিরষ্কার মোহাচ্ছন্নতার জাল ছিন্ন করার জন্য, সকলই বাণীরূপে মূর্ত্ত হয়েছে তাঁর পত্রাবলীতে। ভারতের জাতীয় জীবনে সাধারণের মধ্যে, স্বদেশীদের জীবনে, বিপুল শক্তি সঞ্চার করেছে। আজও তাঁর আহবান প্রাসঙ্গিক যুব সমাজের কাছে। তাই তিনি কালোত্তীর্ণ।
বিবেকানন্দ কবি চিরন্তন। অসাধারণ ছন্দ- স্পন্দিত তাঁর গদ্য। মানুষের রক্তস্রোতকে উত্তাল করে সে গদ্য যা কেবল বক্তব্যের শক্তিতে নয়, বক্তব্যবাহী শব্দধ্বনি তরঙ্গের শক্তিতেও বটে। তাঁর শব্দধ্বনি তরঙ্গে মুগ্ধ হয়ে রোমা রোলাঁ বলেছিলেন, ” বিবেকানন্দ উচ্চারিত শব্দে আছে মহান সঙ্গীত আর বাক্যে আছে বিঠোফেনের বিন্যাস। “
স্বামীজীর বিভিন্ন ইংরেজি ভাষণ ও রচনা থেকে সংকলিত কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক।
” মুক্ত হও। উন্মোচিত হও। এই বাণীর উৎস কোথায়? মানুষ ভাবে, তা এসেছে- ওই সূর্য, চন্দ্র, তারকার ভুবন থেকে। না, উৎস আমরাই- মানুষেরা। আমাদের গভীর থেকেই জাগছে আত্মার সঙ্গীত, অনন্ত মুক্তির সঙ্গীত। “
” মানুষ ঈশ্বরকে ভালোবেসেছে, ভুলে গেছে মনুষ্য ভ্রাতাকে! ঈশ্বরের নামে মানুষ আত্মবলি দেয়, বিসর্জন দেয় নিজ পুত্রকে, দেশের পরে দেশ লুন্ঠন করে, খুন করে অবিশ্রাম, রক্তস্রোতে ভরিয়ে দেয় পৃথিবী – সবই ঈশ্বরের নামে। হায় মানুষ ভালোবেসেছে ঈশ্বরকে, কিন্তু ভুলে গেছে মনুষ্য ভ্রাতাকে।
স্বামীজী ম্যাসাচুসেটস থেকে ২০/৮/১৮৯৩ তারিখে আলাসিঙ্গা পেরুমলকে চিঠিতে লিখছেন – ” ভরসা রেখো না ধনী বা গণ্যমান্যে, জীবনশক্তিহীন মৃত তারা। তোমরা দরিদ্র কিন্তু বিশ্বাসী, ভরসা তোমাদের ওপর।… হে যুবকবৃন্দ! আমি মরতে পারি অনাহারে, শীতে, দুঃখে, যন্ত্রণায়। মরি যদি,আমার দায় তুলে নাও তোমরা। নাও, আমার ভালোবাসার যন্ত্রণা। যাও দীন দরিদ্রের কাছে, জীবন দিয়ে আলো জ্বালাও ওদের ঘরে।”
এক সমাজ দরদী, সমাজ সচেতন সসন্ন্যাসীর উদাত্ত আহবান – ” নতুন ভারত বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালা মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হ’তে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ হতে, কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে । এরা সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে, নীরবে সয়েছে, তাতে পেয়েছে অপূর্ব সহিষ্ণুতা, অটল জীবনীশক্তি। এরা একমুঠো ছাতু খেয়ে দুনিয়া উলটে দিতে পারে।…দিনরাত মুখ বুজে খাটা আর কার্যকালে সিংহের বিক্রম। অতীতের কঙ্কাল উচ্চবর্ণেরা! এই সামনে তোমাদের উত্তরাধিকারী ভবিষ্যৎ ভারত। ” স্বামীজীর ভাবনায় শুদ্রের জাগরণ সত্যি হয়েছে। দুনিয়া উলটে দিয়েছে খেটে খাওয়া কৃষক- শ্রমিকরা। এই মানব প্রেমিক, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, স্বদেশপ্রেমিক দৃপ্ত নায়ক স্বামী বিবেকানন্দের ১৬০ তম জন্মদিবসে চিন্তনের পক্ষ থেকে জানাই অনন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।