কলমের খোঁচা

সাংবাদিক নজরুল


গোপা মুখার্জী :চিন্তন নিউজ:২৫শে মে:- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী । তিনি একাধারে ছিলেন কবি, গল্পকার, সাহিত্যকার , সঙ্গীত রচয়িতাকার , সুরকার, নির্ভীক দেশপ্রেমিক এবং একজন একনিষ্ঠ সাংবাদিক ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষপ্রান্তে করাচী তে বাঙালি পল্টন ভেঙে যাওয়ার পরে তিনি যখন কলকাতায় আসেন তার কিছুদিন আগে থেকেই ‘সওগত’ ও ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি ‘পত্রিকায় তাঁর ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ‘হেনা’, ঘুমের ঘোর , ইত্যাদি কয়েকটি ছোট গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হয়। এবং এখানেই মহম্মদ নাসিরুদ্দিন , মুজাফফর আহমেদ প্রমুখ সম্পাদকের সঙ্গে লেখক রূপে তাঁ পরিচিতি গড়ে ওঠে ।জীবিকা অর্জন ও স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের জন্য তিনি সাহিত্যের পাশাপাশি সাংবাদিকতাকেও পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন ।
বাংলা সংবাদপত্র জগতে কবি নজরুল ইসলামের সাংবাদিক হিসেবে বিশেষ অবদান আছে । তিনি এবং মোজাফফর আহমেদ যুগ্ম ভাবে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আদর্শে সাংবাদিকতার সূচনা করেছিলেন ।একদিকে যেমন শ্রমিক, কৃষক , সাধারণ মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন অপরদিকে তেমনি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আদর্শকে তুলে ধরেছেন ।
নজরুল ও মোজাফফরের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় ‘নবযুগ’ পত্রিকা ।এখান থেকেই শুরু হয় তাঁ সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ি । খিলাফৎ আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে তখন দেশ ছিল টালমাটাল ।এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের চুলচেরা বিশ্লেষণ ফুটে উঠেছে এই পত্রিকায় । নবযুগ পত্রিকাতেই কবির রাজনৈতিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় যার প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ছিল জ্বলন্ত দেশপ্রেম, আন্তর্জাতিক চেতনা এবং বিপ্লব বাদী চিন্তা ।’নভেম্বর বিপ্লব , ‘তুরস্কের বিপ্লব , ‘আয়ারল্যান্ডের বিপ্লব ‘তাঁর প্রেরণার উৎস ছিল বলাই বাহুল্য ।
নবযুগের জনপ্রিয়তার আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল নজরুলের অগ্নি ঝরা লেখা, আকর্ষণীয় হোর্ডিং , বড় সংবাদ কে সুকৌশলে সংক্ষিপ্তকরণ এবং কোনো কোনো সংবাদের শেষে কাব্য ভাষায় মন্তব্য প্রকাশ ।নবযুগ পত্রিকায় ‘দেশের খবর’ , পরদেশপঞ্জী , ‘মুসলিম জাহান’ ইত্যাদি সংবাদ বিভাগ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল ।
মুসলিম জাহানের একটি নমুনা —-
শিরোনাম : দাড়িতে আগুন লেগে অক্কা/ টরে টক্কা টরে টক্কা
জন ক্যামিয়াস নামে ক্যাম্বেলল্যান্ডের এক অধিবাসী একদিন আঁধার রাতে ঘড়ি দেখার জন্য দেশলাই জ্বালে ।দুর্ভাগ্যক্রমে তার দাড়িতে আগুন লেগে জামা ও বিছানায় আগুন লেগে যায় ।শেষে সে আগুনে পুড়ে মরে।
‘এবার টিকিতে আগুন লাগবে কখন? / কি আনন্দ কি আনন্দ কি আনন্দ ……
নজরুল একই সঙ্গে বিপ্লবী কবি এবং বিপ্লবী সাংবাদিকতার ভূমিকা পালন করতে পেরেছেন ।’ মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে’—–এই সম্পাদকীয় লেখার জন্য ব্রিটিশ সরকার নবযুগ পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করে ।
১৯২২ সালের ১১ই আগস্ট প্রকাশিত হয় নজরুলের দ্বিতীয় অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু ‘ । ইতিমধ্যে বিপ্লবী সাংবাদিক হিসেবে তিনি অভিনন্দিত হয়েছেন ।এই পত্রিকা একই সঙ্গে বিপ্লবীদের এবং সাম্যবাদী চিন্তাধারার মানুষ জনের সমর্থন পেয়েছে ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধূমকেতু তে আশীর্বানী পাপিয়ছিলেন—–
আয় চলে আয়রে ধূমকেতু ……
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদকে শিরোধার্য করে নজরুল তাঁর লেখায় আগুন ছোটালেন —–
“আমি যুগে যুগে আসিয়াছি পুন:/মহাবিপ্লব হেতু……..
মহাকাল ধূমকেতু ।”
ধূমকেতুর সম্পাদকীয়তেই তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করলেন —–“সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায় ।ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশ বিদেশের অধীনে থাকবে না।”
পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে ।আর বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে, বুক ফুলিয়ে বলতে হবে —‘ আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ ।’
ধূমকেতুর আর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও সমাজবিরোধীতার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা । মুসলিম সমাজকে স্বাধীনতার মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য নজরুল ধূমকেতুর মাধ্যমে তাঁর কলম চালিয়েছিলেন ।
১৯২৫ সালের শেষাশেষি ডিসেম্বর মাসে ‘লেবার স্বরাজ পার্টি ‘গঠিত হওয়ার পর নজরুলের পরিচালনায় ‘লাঙ্গল ‘ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় ।সেখানে তাঁর বিখ্যাত সাম্যবাদী কবিতাগুচ্ছ প্রকাশিত হয়েছিল যা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ভাবানুসরনে রচিত ছিল ।
রাজনৈতিক কারণে ‘লাঙল ‘পত্রিকা গণবানী’ তে পরিণত হয় ১৯২৬ সালের ২২শে আগস্ট ।নজরুল গণবানীর সম্পাদক ও লেখক ছিলেন ।এই পত্রিকায় নজরুলের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে লেখা কবিতা ‘মন্দির মসজিদ , ‘লাল নিশান , ‘ কান্ডারী হুঁশিয়ার ‘ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়।
১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘সওগাত ‘ পত্রিকার নজরুল ছিলেন সাংবাদিক ও লেখক । ১৯৪১সালে প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ পত্রিকা ‘দৈনিক নবযুগের ‘ তিনি প্রধান সম্পাদক ও লেখক ছিলেন ।
‘নবযুগ, ‘ধূমকেতু , ‘লাঙল ‘ ‘গনবানী’ প্রভৃতি পত্রিকায় নজরুলের সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে । জণজাগরণ ও শ্রমজীবী মানুষ কে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর সাংবাদিকতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে ।সাহিত্যিক প্রতিভার মত তাঁর সাংবাদিক প্রতিভাও ছিল অনেকটাই সহজাত ।রাইটিং , রিপোর্টিং , সিলেকটিং , কাটিং , এডিটিং প্রভৃতি কর্মকৌশল তিনি সাংবাদিকতার শুরু থেকেই প্রয়োগ করতে থাকেন ।কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে সম্পাদকীয় কলমে তিনি এক নতুন রীতির প্রবর্তন করেন ।নজরুলের সাংবাদিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সংবাদের নৈতিকতার প্রতি একনিষ্ঠতা।
‘নবযুগ’ পত্রিকাতে নজরুলের সাংবাদিক জীবনের হাতেখড়ি আর ‘দৈনিক নব যুগে ‘ তাঁর সাংবাদিক জীবনের শেষ ।দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন তিনি ।তাঁর সৃষ্টিশীল জীবন হল স্তম্ভিত , মূক , বধির ।অত্যধিক আর্থিক দুরবস্থা এবং সময়মতো চিকিৎসার অভাবে দীর্ঘ ৩৪ বছর তাঁর অমৃত নির্ঝর কন্ঠ রইলো স্তব্ধ । হয়তো বা যারা শুধু নিলে দিলে না কিছুই তাদের প্রতি অভিমানে তিনি নীরব রইলেন।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।