কলমের খোঁচা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

কোভিড-১৯–পরবর্তী পুনর্বাসন চিকিৎসা কেমন হবে


ডাঃ অর্পণ গাঙ্গুলী: চিন্তন নিউজ:২২শে সেপ্টেম্বর:- বিশ্বে কোভিড-১৯ আজ মহামারি হিসেবে স্বীকৃত। সাস কোভ-২ (SARS COV-2 ) নভেল কোরোনাভাইরাস)–এর মাধ্যমে ছড়ানো এ রোগটি চীনের উহানে আবির্ভূত হয়। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের লাখো মানুষকে এটি আক্রান্ত করে বর্তমানে আমাদের দেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব কটি দেশে তার আগ্রাসী গতিবিধি দেখাচ্ছে।

রোগটি সম্পর্কে এখনও গভীর গবেষণা চলছে। এর দীর্ঘকালীন প্রভাব ও এর সঠিক চিকিৎসা নিয়ে এখনো চিকিৎসকেরা সন্দিহান। এতে আক্রান্ত অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কারও কারও আইসিইউ ইউনিটেও চিকিৎসা চলে।এটি একটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ হলেও এই রোগে তুলনামূলক ভাবে মৃত্যুর হার কম।

এখন পর্যন্ত জানা জটিলতাগুলো হলো এআরএফ (Acute respiratory failure), এআরডিএস(Acute respiratory distress syndrome), হৃদযন্ত্রজনিত সমস্যা, লিভারের সমস্যা, নার্ভের সমস‍্যা,কিডনীর সমস‍‍্যা, ভাইরাল মায়োপেথি ও সেপসিস। কোভিড মুক্ত রোগীদের শরীরের কাঠামোগুলোতে বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তন দেখা দেয়। ফলে তাঁদের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপে ও সামাজিক কার্যক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা আসে। তাই আপাতদৃষ্টে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের পুনর্বাসন চিকিৎসার মাধ্যমে পুনরায় কর্মক্ষম করে তোলা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আর কোভিড-১৯ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা না থাকায় এর সুনির্দিষ্ট পুনর্বাসন চিকিৎসাপদ্ধতিও এখনো অজানা। জার্মানির Lübeck University এই বিষয়ে কিছু নির্দেশিকা তৈরী করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই নির্দেশিকার ওপর সদর্থক আলোচনা করছে। করোনার প্রতিশেধক (Vaccination ) এর মতোই উন্নত দেশগুলো পুনর্বাসন চিকিৎসা বা রিহ্যাবিলিটেশন ( Rehabilitation ) নিয়েও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। আমাদের দেশেও এখন এই বিষয়ে সচেতনতা,গবেষনা চলছে।

পুনর্বাসন চিকিৎসা বা রিহ্যাবিলিটেশন রোগীদের রোগ প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাপদ্ধতির ধারাবাহিকতা নিরূপণ করে এবং পুনর্বাসন চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীকে পুনরায় তার সুস্থ ও স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফেরত আনে। কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত রোগী বাড়িতে থেকে,হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বা আইসিইউ সাপোর্ট পাওয়া রোগীরা এই রোগ থেকে ভালো হয়ে গেলেও কিছু রোগ–পরবর্তী জটিলতা থেকেই যায়। হৃদযন্ত্রের সমস্যা বা স্ট্রোকও কিছু রোগীর মধ্যে পাওয়া যায়, যেখানে অবশ্যই পুনর্বাসন চিকিৎসার প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় হাসপাতালে শুয়ে থাকা বা আইসিইউ সাপোর্ট পাওয়া রোগীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তাঁদের মাংসপেশিতে অবশতা ও দুর্বলতা দেখা দেয়। তা ছাড়া কিছু রোগীর ভাইরাল মায়োপেথিও হয়। এই মাংসপেশির অসাড়তা থেকে বিভিন্ন ধাপে পুনর্বাসন চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব। এ ছাড়া স্বাদ ও গন্ধের যে সমস্যা হয় কোভিড রোগীদের, তা পুরোপুরি সেরে ওঠে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কোভিড–পরবর্তী মানসিক অবসাদ এবং ঘুমের সমস্যাও প্রকট হয়ে ওঠে। তাই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা আইসিইউ সাপোর্ট পাওয়া রোগীদের যত দ্রুত তাঁদের আগের কার্যক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য পুনর্বাসন চিকিৎসার সঠিক প্রয়োগ দরকার।

বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের মাধ্যমে রোগীদের শারীরিক কর্মক্ষমতা নিরূপণ করা হয়। প্রশ্নপত্রে উল্লেখ থাকে, তিনি তাঁর দৈনন্দিন কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারেন কি না। যেমন তিনি নিজে একা তাঁর খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন কি না, স্নান করতে পারেন কি না, টয়লেট ব্যবহার করতে পারেন কি না, সিঁড়িতে ওঠা-নামা বা কিছুক্ষন হাঁটা সম্ভব কি না ইত্যাদি। সঙ্গে দেখা হয় তিনি কি একা চলাফেরা করতে পারেন বা কারও সহযোগিতা প্রয়োজন হয় অথবা আগে থেকেই কোনো লাঠি বা ওয়াকার ব্যবহার করতেন কি না। এসব প্রশ্নের উত্তর নিরূপণ করে বিশেষজ্ঞ পুনর্বাসন চিকিৎসক বা ফিজিক্যাল অ‍্যাডভাইজার প্রত্যেক রোগীর জন্য আলাদা চিকিৎসাপদ্ধতি ঠিক করেন। এই চিকিৎসা একটি টিমের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়,যেখানে থাকেন ফিজিওথেরাপিস্ট, পুনর্বাসন নার্স, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, মনঃচিকিৎসক, পুষ্টিবিদ।

আন্তর্জাতিক রিহ্যাবিলিটেশন ফোরাম এ বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে। তাদের মতে, কোভিড পরবর্তী পুনর্বাসন চিকিৎসার বেশ কিছু ধাপ রয়েছে, যা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হলো
১)মানসিক প্রস্তুতি নিন-
জীবনে পরীক্ষায়, খেলায় বা চাকরির সময় যেমন আপনি মানসিক দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তেমনি এখানেও মনস্থির করুন যে আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসতে হবে। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য, নির্দিষ্ট সময় ঠিক করুন সুস্থ হওয়ার জন্য। দুর্বলতার জন্য এ কাজটি হয়তো আপনি একা না–ও করতে পারেন, প্রয়োজনে পরিবার বা বন্ধুদের সহায়তা নিন। সমাধান না হলে মনঃচিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

২)শক্তি অর্জন করুন-
আগের শক্তি ফেরত আনতে দরকার ব্যায়াম। কোভিড–পরবর্তী প্রথম দিন থেকে ব্যায়াম করুন, যা আপনার ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও মাংসপেশির সক্ষমতা বাড়াবে। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামগুলো করুন (ডায়াফ্রেমেটিক বা ডিপ ব্রিদিং এক্সারসাইজ), সঙ্গে চলুক অ্যারোবিক এক্সারসাইজ। সবচেয়ে সাদামাটা কিংবা সহজ অ্যারোবিক হলো হাঁটা। এ ছাড়া সাইকেল চালানো, দৌড়ানো, জগিং, স্কিপিং ইত্যাদিও এর মধ্যে অন্তর্গত। শরীর বেশি দুর্বল হলে বিছানা ধরে ওঠাবসা করুন বা বিছানায় শুয়ে পা দুটো ওঠানামা করান নিজে থেকে বা কারও সহায়তা নিন। ধাপে ধাপে ব্যায়ামের গতি ও সময় বাড়ান। খেয়াল রাখতে হবে, অল্প ব্যায়ামও ধীরে ধীরে উন্নতিসাধন করতে পারে।

৩)শরীরকে নমনীয় করুন-
বিছানায় শুয়ে থাকাতে শরীরের মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধি হয়ে উঠে শক্ত ও বেদনাদায়ক। তাই দিনে অন্তত দুবার স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করা উচিত। প্রয়োজন হলে কারও সাহায্য নিন।

৪)নিজেকে সংগঠিত করুন-
আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা তৈরি করুন। সঠিক, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করুন কারণ খাদ্যই শরীরের জ্বালানি। পুরোনো রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আর্থ্রাইটিস প্রভৃতি ওষুধের ব্যবস্থাপত্র বুঝে নিন।

পুনর্বাসন চিকিৎসাতেই কোভিড চিকিৎসাপর্বের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত: নিবিড় আইসিইউ ইউনিটগুলো থেকে শুরু করে পরবর্তী পর্যায়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে বা স্টেপডাউন সুবিধায় এবং দীর্ঘ মেয়াদে যখন রোগীরা ঘরে ফিরে আসে এবং ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে। পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও তাঁর টিম কোভিড রোগীদের এই চিকিৎসায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রথম দিকে পুনর্বাসন চিকিৎসা পাওয়া রোগীদের হাসপাতালে কাটানো দিনের সংখ্যাও কমে আসে, যা হাসপাতালে বিছানা–সংকটের এই সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো এই কোভিড–পরবর্তী পুনর্বাসন চিকিৎসাপদ্ধতিটি ‘জাতীয় কোভিড নির্দেশিকা’য় অন্তর্ভুক্ত হওয়া সময়ের দাবি রাখে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।