কলমের খোঁচা

‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন’ সঙ্গীতা ইমাম, ঢাকা, বাংলাদেশ


চিন্তন নিউজ:২৬শে মে:– আজ আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকী। এ দিনে কবিকে জানাই অন্তরের অতল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর প্রণাম। আমরা কবির প্রতিটি জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনে শ্রদ্ধা জানাই। এবার করোনার কারণে আমার যাওয়া হলো না। কিন্তু তাই বলে প্রিয় কবিকে শ্রদ্ধা জানাবো না, তাও কি হয়? গৃহকোণে বসেও তাঁর সৃষ্টি পাঠ ও অনুধাবনে অথবা তাঁর সম্পর্কে বন্ধুদের সাথে কিছু অনুভব ভাগ করে নেয়ার মধ্য দিয়েও তো কবিপ্রণাম জানাতে পারি। আমার সৌভাগ্য, আমি কবিকে দেখেছিলাম তাঁর জীবদ্দশায়। কবি সে সময় তখনকার পিজি হাসপাতাল, যা আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। আমার চাচা সৈয়দ আলী ইমাম একদিন আমাদের ভাইবোনদের নিয়ে কবিকে দেখতে গেলেন। আমরা সকলেই জানি বহু বছর কবি বাকশক্তি ও বোধশক্তিহীন হয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন। সেই অসুস্থ কবিকে দেখেছিলাম হাসপাতালের কক্ষে একটি চেয়ারে বসেছিলেন। আমরা বাড়ির বাগানের ফুল নিয়ে তাঁকে দিলে তিনি কোলের ওপর ফুলগুলি কিছুক্ষণ রেখে নিচে ফেলে দেন। এই আমার কবি-দর্শনের অভিজ্ঞতা।

যেদিন কবি শেষযাত্রায়, সেদিন আমরা টিএসসিতে যাচ্ছিলাম তাঁকে দেখতে। এত ভিড় যে যেতে পারিনি। চাচা বুদ্ধি করে চারুকলার খোলা ছাদে আমাদের নিয়ে গেলেন। সেই ছাদ থেকে আমরা কবিকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা দেখেছিলাম।

‘খুকী ও কাঠবিড়ালি’, ‘লিচু চোর’ কিংবা ‘প্রভাতী’ কবিতার সেই চরণ- “ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠ রে! ঐ ডাকে যুঁই-শাখে ফুল-খুকি ছোটরে!”- কবিতা দিয়ে যে কবির সাথে আমার পরিচয়, সে কবিকে জীবনের নানাবাঁকে নানাভাবে সাথে পেয়েছি। নাচ শিখতে গিয়ে তাঁর ‘মোমের পুতুল’ কিংবা ‘প্রজাপতি প্রজাপতি কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা’ গানের সাথে নেচেছি। অভিনয় করেছি তাঁর ‘শিউলিমালা’ নাটকে। ‘বিদ্রোহী’ কিংবা ‘দাও শৌর্য দাও ধৈর্য্য হে উদার নাথ’ কবিতার সাথে মঞ্চে নৃত্য পরিবেশনের সময় শিহরিত হয়েছি। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ আর ‘এই শিকল পরা ছল’ পরিবেশনের সময় মনেই হয়েছে সব বাধা, সব অনিয়ম আমরাই পারবো দু পায়ে দলে পরিষ্কার করতে। নারী মুক্তির গান বলতেই মনে পড়ে, ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ গানটির কথা।

সমতার বাণী নজরুলের গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে, গল্পে, নাটকে- সমস্ত সৃষ্টিকর্মে। নারী-পুরুষের সমতার কথা শুনি, যখন তিনি বলেন, “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। মানুষের সমতার কথা বলেছেন- “গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান”। শ্রমজীবী মানুষের বেদনার কথা তুলে ধরেছেন- “দেখিনু সেদিন রেলে, কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে”। সম্প্রদায়, জাতি, ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভেদ হানাহানি দূর করে একটি বৃন্তে গাঁথার জন্য রচনা করেছেন- “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ”।

নজরুল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের বিভেদ হানাহানি থেকে মুক্তির কথা বলেছেন। তিনি বিভিন্ন জাতি-ধর্মের মিলনের কথা বলেছেন এবং জীবনাচরণেও তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি ইসলামী হামদ নাত লেখার পাশাপাশি অসংখ্য শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন। ধর্মের এই হানাহানির আজকের সময়ে নজরুলচর্চা অতি জরুরি বলে মনে করি।

আজকাল যখন নতুন করে নারীকে অন্তঃপুরবাসিনী করার নীলনক্সা আঁকছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, তখন নজরুল বড় প্রাসঙ্গিক। কারণ নজরুল তাঁর গানে কবিতায় বিভিন্ন রচনায় নারীকে স্ফূলিঙ্গ হয়ে জ্বলে উঠতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

বিদ্রোহী কবি তরুণদের জেগে উঠতে বলার পাশাপাশি ‘আধমরাদের ঘা মেরে’ বাঁচানোর দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। জীবনের জয়গান গেয়ে তারুণ্যকে কুপমণ্ডুকতা বর্জন করে আকাশ পাতাল নভোমণ্ডল ঘুরে দেখতে বলেছেন। বদ্ধ ঘরে থেকে জীবন নষ্ট না করে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নেয়ার উৎসাহ জাগিয়েছেন।

তাই ‘জাতীয় কবি’ বলে শুধু ফুলের মালা দিয়ে আনুষ্ঠানিকতাটুকুই পালন না করে প্রতিদিনের জীবনযাপনে নজরুলের চর্চা, চর্যা বড় প্রয়োজন। আজকের মানুষকে কুপমণ্ডুকতা থেকে মুক্তি দিতে যুগ-যুগান্তর পরেও তিনি প্রাসঙ্গিক।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।