কলমের খোঁচা

আন্তঃ ন্যাশনাল সঙ্গীত ও কাজি নজরুল ইসলাম


মল্লিকা গাঙ্গুলী: চিন্তন নিউজ:২৬শে মে:–
ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের বিশেষ তাৎপর্য হলো, সমগ্র বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর, দুনিয়ার মজদুর শ্রেণীর সংঘবদ্ধতার প্রকাশ ঘটে এই সঙ্গীতে অর্থাৎ গানটি বিশ্বের মজদুর শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা বোধের সেতুবন্ধন। বর্তমান বিশ্বের চল্লিশটি দেশের চল্লিশটি ভাষায় অথচ একই সুরে এই গান গাওয়া হয়। ভারতবর্ষে বিদ্রোহী কবি সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতটির বঙ্গানুবাদ করেন এবং নাম দেন আন্তঃ ন্যাশনাল সঙ্গীত।

বিশ্বের প্রেক্ষিতে গানটির ইতিহাসের পাতা খুললে দেখা যায়, মানব সমাজের যুগান্তকারী মার্কস-এঙ্গেলসের মতাদর্শের জীবন্ত দলিল কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। যে আদর্শের প্রথম বাস্তবায়ন ঘটে ১৮১৭ সালে প্যারি কমিউন গঠনের মাধ্যমে। কিন্ত মাত্র ৭২ দিনের মাথায় প্যারি কমিউন ধ্বংস করে শত শত শহীদের রক্ত স্নানে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শাসন কায়েম হ’লেও মানুষের চেতনা থেকে শ্রমিক শ্রেণীর সাম্যবাদ কে যে বিনাশ করা যায়নি তার যথার্থ প্রমাণ এই ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীত। প্যারি কমিউনের ইউ জিন পাঁতিয়ে নামের এক ফরাসী শ্রমিক ১৮৭১ সালের ১৪ই মে জীবনের এই মহাসঙ্গীতটি রচনা করেন। তার মৃত্যুর (১৮৮১) সাত বছর পর পিঁয়ের- দো -জিতিঁয়ের নামে অপর এক ফরাসি শ্রমিক গানটির সুরারোপ করেন এবং ১৮৮৮ তে ফ্রান্সের লিঁয় শহরে প্রথম গাওয়া হয় এই মহা সঙ্গীত।

ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুযায়ী ১৯২০ সালে তাসখন্দে ভারতীর কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয়। তখন সারা বিশ্বের কমিউনিস্টদের মধ্যে যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। তাই তাসখন্দে ভারতীর বিপ্লবী মুজাহিদ আব্দুল রহিমের মৃত্যুর (১৯২২) পর তাসখন্দের মাটিতে তাঁর শেষকৃত্যে ভারতীর ভাষা হিসেবে স্বীকৃত উর্দু ভাষায় প্রথম কোনো ভারতীর কমিউনিস্টের জন্য এই ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতটি পরিবেশন করেন কমরেড রহমত আলি জাকারিয়া। এরপর ৩০ এর দশকের শুরুর দিকে বিখ্যাত কবি হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ( বীরেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায় ও সরোজিনী নাইডুর ছোট ভাই) গানটির হিন্দী অনুবাদ করেন। হিন্দী ভাষী লোকের মুখে মুখে ধ্বনিত হিন্দী ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতটি-
“উঠো জাগো ভুখে বন্দী
অব খিঁচো লাল তলোয়ার”

বাংলায় ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের প্রথম অনুবাদক বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের অনুবাদের পিছনে ছিল বাংলার বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা মুজাফ্ফর আহমেদ। কাকাবাবুর স্মৃতি কথা থেকে জানা যায়, তিনি তাঁর প্রিয় কবি নজরুলকে গানটির অনুবাদ করতে বললেও মূল গানের ইংরাজি কপি জোগাড় করতে না পেরে আমেরিকার নাট্যকার সিংক্রেয়ারের “হেল” নাটিকায় উল্লিখিত গানটি পান, এবং এই গানের ই তর্জমা করেন কবি নজরুল। মুজাফ্ফর আহমেদের মতে ব্রিটেনের গানের সঙ্গে মার্কিন গানটির দুই বা তিনটি শব্দের হেরফের হলেও অর্থের কোন ব্যাঘাত ঘটেনি, আর সমগ্র বিশ্বে ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের সুর এক। নজরুল গানটির যথাযথ সুরারোপ করার জন্য কাকাবাবুকে স্বরলিপি জোগাড় করার কথা বলেন কিন্ত তা ও না পাওয়া গেলে মোজাফ্ফর আহমেদ সাহেবের অনুরোধে “গণবাণী” পত্রিকার অফিসে বসেই কবি এর বঙ্গানুবাদ করেন। মুজাফ্ফর আহমেদের মতে নজরুলের অনুবাদটি বাংলা ভাষার তো বটেই ভারতীয় সমস্ত ভাষার থেকে সর্বোৎকৃষ্ট অনুবাদ। নজরুল অবশ্য চেয়েছিলেন মূল গানটির অনুবাদ পাওয়া গেলে তিনি আবার পরিমার্জন করে দেবেন কিন্ত তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুজাফফর আহমেদ বা নজরুল কারো পক্ষেই তার আর সুযোগ হয়নি। গণবাণীতে প্রকাশের পর কবি আন্ত ন্যাশনাল সঙ্গীত নাম দিয়ে তাঁর ফণীমনসা কাব্যগ্রন্থেও ছাপান। এখান থেকেই নজরুলের কবিতা সংকলন সঞ্চয়িতাতে গানটি স্থান পায়। যদিও কাকাবাবুর স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়, সঞ্চয়িতার কোরাস গান হিসেবে মুদ্রিত অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীতটিতে অনেক ভুল ছিল, যা সংশোধন করার অনেক সুযোগ থাকলেও সঞ্চয়িতার সম্পাদিকা বিশেষ গুরুত্ব দেননি বলে ও কাকাবাবুর খেদ ছিল।

পরবর্তী কালে ১৯২৮ সালে প্রবাসী সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুরকে মুজাফফর আহমেদ মূল ফরাসী গানটির নোটেশন পাঠানোর অনুরোধ করেন। কিন্ত তিনি না পাঠিয়ে নিজেই ফরাসী গানটির লিরিকের হুবহু তর্জমা করেন। আরও পরে ১৯৪২ সালে মোহিত চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ মজদুরের লেখা গানটির বাংলা অনুবাদ করেন। ভারতীর কমিউনিস্ট পার্টি মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদটি গ্রহণ করে। ভারতের সব ভাষাতেই আজ ও মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতটি গাওয়া হয়ে আসছে। তবে একথা নিঃসন্দেহে স্বীকার করতেই হয় , কাজি নজরুল ইসলামের প্রতিভার বিদ্যুচ্ছটা তার অসংখ্য কাব্য, কবিতা, গানে বিচ্ছুরিত। নজরুলের কাব্য বীণা “অগ্নিবীণা” যার তন্ত্রে তন্ত্রে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গের অগ্নি প্রবাহ পরাধীন ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের মূল মন্ত্র হয়ে ওঠে। আর তাঁর “বিষের বাঁশি”র সুর মূর্ছনায় সমগ্র বঙ্গবাসী উদ্বেলিত হয়।

সময় ও পরিস্থিতির কারণে নজরুলের অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত অনুবাদে কিছু খামতি থাকলেও বাংলা ভাষার প্রথম আন্তঃ ন্যাশনাল সঙ্গীত রচয়িতা কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
ল্যাটিন আমেরিকার ঘন জঙ্গল কিম্বা কোক কফি ক্ষেতের আড়ালে মার্কিন যুদ্ধ বিমান ধ্বংস করে বিদ্রোহী সেনার কন্ঠে মুখরিত হয় যে গান, সেই গান শোনা যায় আফ্রিকার কালো মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠে, সেই গানই ভিয়েতনামের দিয়েন- বিয়েন- ফু এর যুদ্ধের দুঃসাহসী সেনাপতি ভো- নগুয়েনের বিজয়দৃপ্ত গলায়, রাশিয়ার মুক্তি যুদ্ধে ক্রেমলিনের মাথায় লাল পতাকা উড়িয়ে যে গান গেয়েছিল মুক্তিকামী নিপীড়িত মানুষ সেই একই গান আমার দেশের মাটিতে যেখানেই লড়াই, যেখানেই অধিকার বুঝে নেওয়ার সংগ্রাম সেখানেই কমরেডদের উজ্জীবিত করে এই অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত। বাগদাদ থেকে বার্লিন, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতার রাজপথ পৃথিবীর সর্বত্র এক বুক প্রত্যয় নিয়ে লড়াকু নির্যাতিত মানুষের বাঁচার গান অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত।
নজরুল অনুদিত অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত-
“জাগো অনশন বন্দী, উঠ রে যত, জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত।
যত অত্যাচারে আজি বজ্র হানি,
হাঁকে নিপীড়িত জন-মন মথিত বাণী,
নব জনম লভি’ অভিনব ধরনী ওরে ওই আগত…. “

মোহিতলাল চট্টোপাধ্যায় কৃত বহুল প্রচলিত অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত-
“জাগো জাগো সর্বহারা
অনশন বন্দী ক্রীতদাস ,
শ্রমিক দিয়েছে আজ সাড়া
উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস
সনাতন জীর্ণ কু -আচার
চূর্ণ করি জাগো জনগন,
ঘুচাও এ দৈন্য হাহাকার
জীবন মরণ করি পণ।
শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড,
এসো মোরা মিলি একসাথ।
গাও ইন্টার ন্যাশনাল
মিলাবে মানব জাত।।”


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।