গৌতম রায়, চিন্তন নিউজ, ১৯ আগষ্ট: মোহাম্মদ আকরম(১৮৬৮-১৯৬৮) সাংবাদিক, রাজনীতিক, ইসলামি শাস্ত্রজ্ঞ। তিনি অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে ১৮৬৮ সালের ৭ ই জুন জন্মগ্রহণ করেন। আকরম খাঁ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তেমন সুযোগ পান নি। সত্যানুসন্ধানী আকরম খাঁ ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ও ভারতের মুসলমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন আপন মেধা ও ধী শক্তির বলে।
পেশাগত ও রাজনৈতিক জীবন খুব অল্প বয়সেই শুরু করেছিলেন আকরম খাঁ। সাংবাদিক হিসেবে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন ‘আহল-ই-হাদিস’ ও ‘মোহাম্মদী আখবার’ পত্রিকাতে। আকরম খাঁ ১৯০৮ থেকে ১৯২১ সালের ভিতরে মোহাম্মদী ও আল-এসলাম পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এই সময়েই তিনি নিজে কলকাতা হতে ১৯২০ থেকে ১৯২২ সালের ভিতরে ‘জামানা’ ও ‘সেবক’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন। ‘সেবক’ পত্রিকাটি অসহযোগ ও স্বদেশী আন্দোলনকে গভীর ভাবে সমর্থন করেছিল। ব্রিটিশ কর্তৃক ‘সেবক’ নিষিদ্ধ হয়। ব্রিটিশ সরকার বিরোধী সম্পাদকীয় লেখার জন্য আকরম খাঁ গ্রেপ্তার হন। পরে ১৯৩৬ সালের অক্টোবরে তিনি ওই সময়ের একমাত্র বাংলা দৈনিক পত্রিকা আজাদ প্রকাশ করেন। এ পত্রিকাটি বঙ্গ বিভাগোত্তরকালে মুসলিম লীগের পক্ষে জনসমর্থন সৃষ্টির ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখে।
আকরম খাঁ তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন জাতীয় কংগ্রেসের একজন সাধারণ সমর্থক হিসেবে। বাঙালি মুসলমানদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করাই ছিল তাঁর রাজনীতিতে যোগদানের প্রাথমিক লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই তিনি ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠনের ক্ষেত্রেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত খিলাফতৃর অধিবেশনে তিনি খিলাফত কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। এএ সম্মেলনে বিশিষ্ট খেলাফত নেতৃবৃন্দ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৫-১৯৫৮), মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০) এবং মৌলানা মুজিবুর রহমান (১৮৭৩-১৯২৪) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আকরম খাঁকে তুরস্কের উসমানী খিলাফতের জন্য অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯২০ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশে জনগণকে অবহিত করার জন্য বাংলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে জনসভার আয়োজন করেছিলেন।
হিন্দু- মুসলিম সম্প্রীতি ছিল আকরম খাঁ র ধ্যান জ্ঞান। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯২২ সালে কলকাতায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টি এবং ১৯২৩ সালে দেশবন্ধুর নেতৃত্বে সংগঠিত বেঙ্গল প্যাক্ট এর প্রতি তিনি জোরালো সমর্থন জানান। ১৯২৬-১৯২৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সমসাময়িক অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে আকরম খাঁ ভারতীয় জাতীয় রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে স্বরাজ্য পার্টি ও কংগ্রেস উভয় দল থেকেই পদত্যাগ করেন।
১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তিনি প্রজা বা কৃষক রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৫ সালে বেঙ্গল প্রজা সমিতিতে অনৈক্য দেখা দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৬ সালে তিনি কৃষক রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন করেন। তারপর সক্রিয়ভাবে মুসলীম লীগে যোগদান করেন। আকরম খাঁ ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সমিতির সদস্য ছিলেন। ভারত বিভাগের পর তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্থানে চলে আসেন। ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
মৌলানা আকরম খাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ সমস্যা ও সমাধান, মোস্তফা চরিত, আমপারার বঙ্গানুবাদ। তাঁর ‘মোসলেম বাংলার সামাজিক ইতিহাস’-গ্রন্থে তিনি পীরবাদ ও সুফীবাদের প্রভাবসহ বাঙালি সমাজের বিভিন্ন দিক এবং বাঙালি মুসলমানদের অবনতির কারণ বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছেন। আকরম খাঁ সম্রাট আকবরের দীন-ই-ইলাহী’র সমালোচক ছিলেন। আওরঙ্গজেবের ধর্মনিষ্ঠা ও তৎকালীন সমন্বয় প্রবণতার বিরুদ্ধে তার জেহাদের প্রশংসা করেছিলেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ১৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।