কলমের খোঁচা

মে দিবস তুমি নিয়ে এসো ঘৃণা মূলধনে–সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:১লা মে“আর্থিক সংকট তো রাজনৈতিক সংকট থেকে আলাদা নয়, তারা পরস্পরের প্রতিবিম্ব । এই সোজা সত্যটি সম্প্রতি আমরা যে অভিজ্ঞাতর ভিতর দিয়ে গেছি, যাচ্ছি, তা থেকে প্রাঞ্জলতম হয়েছে, হচ্ছে।” এই কথা গুলি বহুবছর আগে তৎকালে আমাদের দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝাতে (১৯৮১ সালে) তার “ সংকটের স্বরূপ” প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন সমাজবিজ্ঞানী ডঃ অশোক মিত্র। আজ ২০২০ সালে করোনার অভূতপূর্ব সর্বগ্রাসী হামলার পরিমন্ডলে বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী যখন পালন করতে যাচ্ছেন তাদের আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ব দিবস“মে দিবস” তখন, এতটা সময় পার করে এসেও কী এই কথাগুলিকে এতটুকু অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে ? মনে হচ্ছে কী সামান্যতম কম অর্থবহ ?

ওয়াশিংটন, বার্লিন, প্যারিস, রোম, মাদ্রিদ, টৌকিও বা মস্কো থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতা— খুঁজে পাবো আমরা এর সত্যতা।এক মুহূর্তে আমি, আপনি বুঝে যাবেো “ যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোরন নেই / পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।” আজ যারা বনে গেছে এই বিপুলা পৃথিবীর স্বঘোষিত অধিশ্বর একমাত্র তারাইতো এই গ্রহ টাকে যথেচ্ছ ভাগাভাগির, ভাঙাভাঙির হরির লুটের অধিকারী। এ ধরা ধামের সব প্রাকৃতিক সম্পদ ও শ্রমশক্তিকে বেমালুম আত্মসাৎ করার ‘শাসনযন্ত্র’ সেতো তাদেরই হাতে ! ‘শ্রেণী নিরপেক্ষ’ এই অত্যন্ত ছেঁদো কথা টাকে এমনকি নিতান্ত নিরীহ পর্দারও আড়াল মুক্ত করে হাতে গোনা কয়েকজন এহেন অধিশ্বরের বক্ষপুটে বিপুল সম্পদকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে অর্পন করার ‘আইন সম্মত’ রাষ্ট্রীয় ফন্দি-ফিকির, ছলা-কলার অর্জিত বিদ্যাতো একমাত্র ওদেরই করায়ত্ত !

১৯৪৪ সাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখনও চলামান।যুদ্ধোত্তর বিশ্ব পরিস্তিতির বিপর্যয়কর পরিণতির আনুপূর্বীক গা ছমছমে ব্যাক্ষা সহকারে নতুন সুন্দর পৃথিবীর সাম্য ও সার্বিক স্বাধীনতার সুখস্বপ্নে যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন পৃথিবীকে আলোর পথদীশা দেখানোর ধূম্রজ্বাল নির্মাণ করে ধনবাদী দুনিয়ার ইচ্ছানুসারে জন্ম দেওয়া হয়েছিল তাদের নিরঙ্কুশ স্বার্থ সম্পৃক্ত দুটি মায়াবী মারিচের । প্রথমটি International Monetary Fund-IMF(আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার), দ্বিতীয়টি International Bank for Reconstruction and Development- World Bank(বিশ্ব ব্যাঙ্ক)। সাময়িক, অতি সাময়িক সুকৌশলী অভিনয়ের পালা সাঙ্গ করে এই দুটি প্রতিষ্ঠান কুচক্রী ধনবাদী দুনিয়ার ইচ্ছাপুরণে অবশিষ্ট দুনিয়ার বলা বাহুল্য বিশেষ করে অবশিষ্ট দুনিয়ার “জঞ্জাল” লক্ষ-কোটি শ্রমজীবি মানুষের জীবনে কি দুঃসহ দুরবস্থা নামিয়ে এনেছিলো তার সন্ধানে অন্য কোথাও যেতে হবে না।

আমাদের দেশ ভারতবর্ষের বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রমজীবি গরীব মেহনতী জনগণের জীবনমানের চূড়ান্ত ক্রমাবনতীর দিকে দৃষ্টি ফেরালেই তা বোধগম্য হবে। ঝড়ের বেগে কমেছে বেতন,মজুরি তো সাইক্লোনের বেগে কমেছে নিয়োগ। নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে যথেচ্ছ ছাঁটাই । আবছা হতেহতে ক্রমশ বিলীনপ্রায় সভ্যতার সামান্য ইঙ্গিতবাহী জীবন ধারনের সামান্য সুযোগ- সুবিধা টুকুও। নানা ছুতোয় আইনকরে কাড়া হয়েছে সংগঠিত হওয়ার, প্রতিবাদ নথিভূক্ত করার এতাবৎ স্বীকৃত অধিকার গুলি। এমনকি নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছে এখনো হয়ে চলেছে দুনিয়া জোড়া রক্তক্ষয়ী দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের শীর্ষে অর্জিত আট ঘন্টা কাজের ও ধর্মঘটের অধিকার। যুগপৎ সংগঠিত এবং অসংগঠিত উভয়ক্ষেত্রই এই হামলার বিচরণ ভূমি। “যে খাটবে সে খাবেনা, যে সব দেবে সে কিছু পাবেনা” এই হচ্ছে পুঁজির যথেচ্ছাচারের সাদা- সোজা পথ আর মোদ্দা কথা। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঠিক যেমন বলেছেন,“ আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে / কারা যেন আজো ভাত রাঁধে / ভাত বাড়ে, ভাত খায়। / আর আমরা সারারাত জেগে থাকি / আশ্চর্য ভাতের গন্ধে, / প্রার্থনায়।” প্রাপ্য ন্যায্য অধিকারের ওপর লুটে খাওয়াদের আক্রমণের লক্ষ্য যেহেতু নিরুপায় শ্রমশক্তি, আর তার চরিত্র যেহেতু বহুমুখী এবং আন্তর্জাতিক অস্তিত্ব রক্ষায় প্রতিবাদ প্রতিরোধও অতএব দেশ থেকে দেশান্তরে সংগঠিত, প্রসারিত ও সংহত হয়ে গ্রহণ করেছে আন্তর্জাতিক অবয়ব। ক্রমান্বয়ে রূপ বদলে উত্তরসত্য, তথ্য সাম্রাজ্যবাদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদের অস্ত্রে সজ্জিত বিশ্ব পুঁজিবাদ বা লগ্নী পুঁজি যখন বিশ্বব্যাপী তার অবাধ গতায়াতের পথ পরিক্রমায় আদতে আক্ষরিক অর্থেই পুতিগন্ধময় ধান্দার ধনতন্ত্রে পর্যবসিত তখন সম্মিলিত রক্তে ও ঘামে গড়ে ওঠা সম্পদের বন্টনে শুধু শকুন ও শেয়ালর খাদ্য যোগানোর স্বার্থ ও উদ্দেশ সংশ্লিষ্ট চূড়ান্ত সচেতন বৈষম্য, মুষ্টিমেয়র স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদের ন্যুনতম বিবেচনা রহিত যথেচ্ছ লুঠ, ধনী দরিদ্রের মধ্যবর্তি জীবনরেখার সুস্পষ্ট প্রকট পার্থক্য, লুম্পেন লুঠেরাদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বলয়ের অন্তর্ভূক্ত করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ছাপান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতিওয়ালা স্বীকৃতি এতসবই হয়ে উঠলো তার ঘৃণারও অযোগ্য বৈশিষ্ট । এই বেলেল্লাপনার বিরূদ্ধেও এ দেশ, এ পৃথিবী তাই বারবার দেখেছে সর্বহারার সব পাওয়ার স্বপ্ন লালিত রণহুঙ্কার। সভায়, সমাবেশে, ধর্মঘটে—অকুতোভয় শ্রমজীবির ‘তিমিরবিনাশী’ প্রতিজ্ঞার বজ্রনির্ঘোষে এদেশে, এ পৃথিবীতে বারবার স্তব্ধ হয়েছে, বেপথু হয়েছে পুঁজির দাসত্বের প্রতিবাদহীন বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণের সুখ বিলাস। জাতের নামে বজ্জাতির রাষ্ট্রীয় বর্বরতার বেআব্রু প্রদর্শন শ্রমিক শ্রেণীর এই লৌহদূঢ় ঐক্যকে কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়তো করতে পেরেছে সভ্যতার দুশমনরা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী,শ্রেষ্ঠ শিক্ষা যখন জীবনলব্ধ তখন জীবনেরই মূখোরিত সখ্যে এই অস্ত্রও লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সক্ষম হবেন বিশ্ব শ্রমিকশ্রণী। “ মুক্ত করো ভয়, / দুরূহ কাজে নিজেরই দিও / কঠিন পরিচয়।” আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস “ঐতিহাসিক মে দিবস” উদযাপনের চির অম্লান তাৎপর্য এখানেই। হ্যাঁ, একথা ঠিক “আপাতত ইতিহাসে অশ্লীলতার প্রলেপ।” কিন্তু তা চিরস্থায়ী হতে পারেনা।

পৃথিবীতে তো বটেই, আমাদের দেশে এবং রাজ্যে উভয়বিধ শাসকবর্গের চরমতম ভন্ডামি, দূরাচার, দূর্নীতি, নির্ভেজাল মিথ্যাচার, চূড়ান্ত প্রশাসনিক অপদার্থতা, চক্ষু লজ্জার বালাইহীন হাস্যকর দম্ভ, জনস্বার্থের সঙ্গে নিতান্ত সম্পর্কহীন অমানবিক ঔদ্ধত্যের অসহ্য যন্ত্রণার আবহের মধ্যেও মনকে শক্ত করে তাই ডঃ অশোক মিত্রের প্রতি আবার অশেষ ঋণ স্বীকার করে যে কথার উপস্থাপনার মাধ্যমে এই লেখায় বোধকরি ইতি টানা যেতে পারে, “আপাতত চোখের সামনে অভব্য অভিনয় চলছে, আপাতত হয়তো ভয়ঙ্কর সাহসব্যঞ্জক কিছু করার নেই, সেটা হটকারিতা হবে, কিন্তু অন্তত কিছুটা ঘৃণা পুষে রাখুন। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা অর্থহীন অসাধুতা, সমাজে বিপ্লব আনতে হ’লে সর্বাগ্রে দরকার কিছু ঘৃণার মূলধণের, এই ঘৃণা থেকেই একদিন সাহসের অক্ষৌহিণী সূষ্টি হবে”(সূত্রঃ সংকটের স্বরূপ, পৃষ্ঠা ৪৯)। তাই আমরা বলবো, মে দিবস তুমি এসো বারবার, আমাদের ধমনীর রক্ত প্রবাহে অহরহ থাকে যেন তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি। এবার তুমি আমাদের জন্যে নিয়ে এসো মুঠোমুঠো ঘৃণা। শত য়ড়যন্ত্রের জ্বাল ছিন্ন করে সুনির্মল পৃথিবী গড়ার কার্যক্রম পরিচালনায় এই হোক আমাদের শ্রেষ্ঠ মূলধন।
——————


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।