কলমের খোঁচা

“গণিত শিল্পী” কেশবচন্দ্র নাগ


সায়ঙ্ক মন্ডল:-চিন্তন নিউজ:-১০ই জুলাই:- আজ হুগলী জেলার অন্য তম অঙ্কের জনক কেশব চন্দ্র নাগ (KC NAG) জন্মদিবস। ১৮৯৩ সালের ১০ জুলাই, রথযাত্রার দিন হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন কেশব চন্দ্র নাগ। ১৯১২ সালের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতায় এসে ১৯১৪ সালে রিপন কলেজ ( অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে আইএসসি প্রথম বিভাগে পাশ করেন।

ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে থার্ড মাস্টার হিসাবে কর্মজীবনের শুরু। কিছুদিনের মধ্যেই সংসারের দায়িত্ব সামলেও চাকরি ছেড়ে অঙ্ক ও সংস্কৃত নিয়ে বিএ পাশ করেন। এরপর অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে কিষেণগঞ্জ হাইস্কুল যোগ দিলেন। পরবর্তীতে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলে যোগ দেন। অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে তার সুখ্যাতি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কালে। আসলে তিনিই কেশবচন্দ্রকে ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে অঙ্কের শিক্ষক হিসাবে নিয়ে আসেন সুদীর্ঘ কর্মজীবন শেষে এখান থেকেই তিনি প্রধানশিক্ষক হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন।
কলকাতায় প্রথমদিকে রসা রোডে মেসে ভাড়া থাকতেন। পরে ১৯৬৪ সাল থেকে থাকতে শুরু করেন দক্ষিণ কলকাতার গোবিন্দ ঘোষাল লেনে নিজস্ব বাড়িতে। 

মিত্র ইনস্টিটিউশনে কেশবচন্দ্রের সহকর্মী কবিশেখর কালিদাস রায়ের বাড়িতে বসত সাহিত্যিকদের আড্ডা রসচক্র সাহিত্য সংসদ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেনের মতো দিকপাল সাহিত্যিকরা সেখানে নিয়মিত আসতেন। কেশবচন্দ্রও সেখানে অন্যতম সদস্য হয়ে ওঠেন। সম্ভবতঃ কবিশেখর কালিদাস রায়ের প্রধান অনুপ্রেরণায় তিরিশের দশকের মাঝামাঝি প্রকাশক ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্সের মাধ্যমে ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হল নব পাটীগণিত। কিছুদিনের মধ্যেই পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে পড়ে বইটি। পাঠ্যপুস্তক হিসাবেও স্বীকৃত হয়। ১৯৪২ সাল নাগাদ ক্যালকাটা বুক হাউসের পরেশচন্দ্র ভাওয়ালের আগ্রহাতিশয্যে কেশবচন্দ্রের বাঁধানো অঙ্কের খাতা প্রকাশিত হয় অঙ্কের সহায়িকা ম্যাট্রিক ম্যাথমেটিক্স নামে। বইটি বিশাল জনপ্রিয় হয়।

একে একে আরও অঙ্কের বই প্রকাশিত হয়। ধীরে ধীরে ইংরেজি, হিন্দি, নেপালি, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় অনুদিত হয় তার বই। গণিতের বইয়ের অসম্ভব জনপ্রিয়তা দেখে ১৯৫৫ সালে তিনি নাগ পাবলিশিং হাউস নামে নিজের প্রকাশনা সংস্থা খোলেন। তার বই বিক্রি থেকে পাওয়া রয়্যালটির টাকার একটা বড় অংশ দেয়া হয় দুটি চ্যারিটি ফান্ডে; একটি তার নিজের নামে, অন্যটি তার স্ত্রী লক্ষ্মীমণির নামে।

কেশবচন্দ্র ছিলেন অনুবাদকের ভূমিকায়তেও , স্বামী অভেদানন্দের বহু ইংরাজি বক্তৃতা ও ভগিনী নিবেদিতার লেখা অনুবাদ করেছেন।  নিয়মিত ডায়েরি লিখেছেন। নাম দিয়েছিলেন রত্ন-বেদী। এতে রয়েছে বহু কবিতা, ভক্তিমূলক গান। আবার একই সঙ্গে রয়েছে নানা ধরনের রসিকতার কথাও। ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য যেখানে যে মন্তব্যটি মনে ধরেছে, টুকে রেখেছেন এই খাতায়। আর খাতার উপরে লিখে রেখেছেন বিনা অনুমতিতে পাঠ নিষেধ।

স্বাধীনতা আন্দোলনেও সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র। মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণও করেন। গান্ধীজীর ‘অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ’ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন জাতীয়তাবাদী এই শিক্ষাবিদ। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য পাওয়া সনির্বন্ধ অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাকে বলতেন ‘গণিত শিল্পী’। খেলাধুলাতে তার প্রবল উৎসাহ ছিলো। তিনি আজীবন মোহনবাগান ক্লাবের সদস্য ছিলেন।

১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ কানপুরে অনুষ্ঠিত ভারত-ইংল্যান্ড টেস্টের ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে উত্তেজনায় সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়। আর দু’বছর পর ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭ কেশবচন্দ্র মারা যান।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।