কলমের খোঁচা দেশ

সিন্ধু সভ্যতার অংশ গুজরাটে লোথাল, এক বিস্ময়।


চিন্তন এর বিশেষ প্রতিবেদন , কল্পনা গুপ্ত, চিন্তন নিউজ: ২৮/০৪/২০২৪:- সালটা সম্ভবত ২০১৮ হঠাৎই গুজরাট ভ্রমণের যোগাযোগ হয়ে গেল ‘যাচ্ছি’ ট্রাভেলস এর সাথে। আমাদের যাবার জায়গাগুলির মধ্যে লোথাল যেন থাকে, বলে যাওয়া নিশ্চিত করা হলো। সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে কৌতুহল আমার মত প্রায় অনেকেরই থাকে। হরপ্পা- মহেঞ্জোদারো সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম নাম। সকলেরই জানা আছে যে তাদের অবস্থান বর্তমান পাকিস্তানে। হরপ্পা সভ্যতার মূল অংশ দক্ষিণে গুজরাট থেকে শুরু করে সিন্ধু ও রাজস্থান জুড়ে এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এছাড়াও এর বাইরেও আরো এক সাইট আছে। হরপ্পা সভ্যতা খৃষ্টপূর্ব ৩৫০০ – ১৪০০ অবধি। এখানকার সভ্যতা ধ্বংসের কারণ প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তন। বিশেষত জলবায়ুগত পরিবর্তন। বেশকিছু গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমানের থর মরুভূমি একসময় একটি আর্দ্র অঞ্চল ছিলো, কম বৃষ্টিপাত যুক্ত। সেখানে ছিলো লম্বা লম্বা সাভানা ঘাস। পরে ভূমিরূপ গঠন পর্যায়ের সাথে সাথে জলবায়ুর পরিবর্তন হয়ে বর্তমানের বৃষ্টিহীন মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে।

হরপ্পা সভ্যতার দক্ষিণতম স্থান গুজরাটের ভাল অঞ্চলে অবস্থিত। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন ২২০০ খৃষ্টপূর্বে এখানে নগর সভ্যতা গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৫৪ সালে আবিষ্কৃত হয় লোথাল। লোথাল অবস্থিত আমেদাবাদ জেলার ঢোলকা তালুকার সাগরওয়ালা গ্রামের কাছে। লোথালের কিছুটা দক্ষিণে খাম্বাত উপসাগর।

লোথাল দেখতে এসে প্রথমেই চোখে পড়েছিলো ওখানকার রাস্তাঘাট, কুয়ো, পয়:প্রণালী, ঘর, উঁচু ঢিবিতে এক্রোপলিস ইত্যাদি নির্মানে ব্যবহৃত সুসজ্জিত ও দৃঢ ইটের ব্যবহার। ৪০০০ বছরের অধিক প্রাচীন এই স্থান যা দীর্ঘকাল ধ্বংসস্তুপের নীচে চাপা পড়েছিলো, উদ্ধার করার পরেও তার গঠনশৈলির নিপুনতা এখনো বিস্মিত করে। কিছু বিতর্ক থাকলেও বিভিন্ন প্রমাণ সাপেক্ষে মনে করা হয় যে লোথাল হলো বিশ্বের প্রাচীনতম বন্দর। এর বাণিজ্যপথ সুদুর পশ্চিম এশিয়া হয়ে আফ্রিকার দূরতম দেশগুলি সাথে যুক্ত ছিলো। বাণিজ্যে পুঁতি, হাতির দাঁত, তুলো রপ্তানি করতো এবং তামা, টিন, ল্যাপিস লাজুলি, ফিরোজা ইত্যাদি আমদানি করা হতো। সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম লোথাল মৃৎশিল্প, শিল্প, সিলের নিজস্ব গঠনশৈলী তৈরি করেছিলো।

তাদের একটা উন্নততর সামাজিক সংগঠন ও প্রশাসন ছিলো। বসতি মাঝখানে উঁচু ঢিবির মত জায়গায় এক্রোপলিসে থাকতো প্রশাসক ও সম্ভ্রান্ত পুরোহিত সম্প্রদায়। চারপাশের নীচু ও সমতল জায়গাগুলোতে থাকতো সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ। ঘরগুলো বেকড ইট দিয়ে তৈরি। জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা খুব সুন্দর। এখানকার ডকইয়ার্ডটি সবরমতি নদীর সাথে সংযুক্ত ছিলো। আমদানিকৃত পণ্য রাখার জন্য ৬৪ কক্ষ বিশিষ্ট বিরাট গুদাম ঘর ছিলো। সেখানে পণ্য ওজনের জন্য একটা মঞ্চ ও আচার অনুষ্ঠানের একটি অগ্নিবেদি ছিলো।
লোথাল সাইট দেখতে এসে দেখলাম একটি উন্নতমানের যাদুঘর। ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগের। সেখানে লোথালের গঠনশৈলির একটি মিনিয়েচার আছে। আছে তাদের ব্যবহৃত পুঁতি, মৃৎপাত্র, অলংকার,ধাতব দ্রব্য ইত্যাদির সংগ্রহ। লোথালে কারিগর, বনিক, কৃষক, নাবিক, পুরোহিত ও শাসক সবরকম পেশায় যুক্ত মানুষ থাকতো যারা সুশৃঙ্খল, আইন পরায়ন। গবেষকরা বলেন যে প্রধানত বন্যা ও ঝড়ের প্রকোপে,দীর্ঘ সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সিন্ধু সভ্যতার এই অংশটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো। এর সাথে ছিলো উপজাতি আক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের প্রভাব। ফলে লোথাল ১৮০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে পরিত্যক্ত হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে পলি বালি দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে। বহু শতাব্দীর বিস্মৃতির ধুলো সরিয়ে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৫৪ সালে লোথালকে আবিষ্কার করে।


লোথাল সিন্ধু সভ্যতার নানান নিদর্শন নিয়ে অপেক্ষমান আমাদেরই জন্য। এই প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটটি দেখার সময়ে সত্যিই এক বিস্মৃত সময়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার শিহরণ অনুভব করেছিলাম। একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম সেই বিরাট ভূখন্ডের মধ্যে যা আমাদেরই মাতৃভূমি। আমরা সাড়ে চার হাজার বছর পরের আগন্তুক তোমাদেরই সভ্যতায়।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।