সূপর্ণা রায়:চিন্তন নিউজ:২৫শে মার্চ:–১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট থেকে ১৯৮১ সালের ১৫ ই আগষ্ট দীর্ঘ ছ’টি বছর ধরে এই বাড়ির সবকটি ঘর ছিল তালাবন্ধ।। ততদিনে ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠেছে ধানমন্ডির সেই বাড়ি।।যার পরিচিতি””৩২ নম্বর”” নামেই।। যেখানে প্রায় ১৪ বছর সপরিবারে ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সঙগ্রামের মহানায়ক।। বাঙালির স্বাধিকার থেকে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রহর গুলো এখানেই গুনেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।।
বাড়িতে ঢুকে নিচতলায়তেই চোখে পড়ে বঙ্গবন্ধুর বড় একটি প্রতিকৃতি।। প্রথম ঘরে সাজিয়ে রাখা ছবিগুলো কথা বলে ইতিহাসের নানা সময়ের।।সেই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপচারিতা ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের ছবি।। একটা ঘর ছিল ড্রয়িং রুম, যেখানে বসে বঙ্গবন্ধু দেশ-বিদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।।এই ঘরের পাশের ঘরটি ছিল বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘর।। এখানে বসে তিনি লেখালেখি করতেন।। দোতলাতে ছিল সাদামাটা একটি টেবিল আর তাকে ঘিরে আটটি কাঠের চেয়ার।।এটি খাবার জায়গা।। টেবিলের উপর সাজানো কয়েকটি থালাবাটি, পেয়ালা ও চামচ।।পাশেই কালো রেক্সিন এ বাঁধানো হাতল ছাড়া কয়েকটি সোফা।। আহারের পর এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন বঙ্গবন্ধু।।পাইপে তামাক সাজতেন।। সেরকম একটা ছবিও টাঙানো আছে পাশের দেওয়ালে।।সব যেন খুব জীবন্ত।।নেই শুধু তিনি।। ঘাতকদের নিষ্ঠুর বুলেটে নিহত না হলে এবছর তিনি শতায়ু হতেন।।
ধানমান্ডির বাড়ির প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু, তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা, তিন ছেলে এবং পরিবারের অন্যদের আরও অনেক স্মৃতি।। দোতলার প্রথম ঘরটি বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করতেন।।এর পরের ঘরটি ছিল বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘর।। বিছানার পাশে রাখা ছোট টেবিলে সাজানো পাইপ ও তামাকের কৌটো।। মাথার কাছে টেবিলে রাখা সাদা, সবুজ ও কমলা তিনটে টেলিফোন।। আর একটি রেডিও।। আসবাবপত্র বলতে এই।। আর আছে রক্ত মাখা কিছু পোষাক।। পাশের ঘরটি কন্যা শেখ রেহানা র।। বিভিন্ন প্রদর্শন সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে শেখ রাসেলের খেলার জিনিস।।আছে রাসেলের বল,হকিস্টিক,ব্যাট ও হেলমেট।।
১৯৬১ সালের ১ লা অক্টোবর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান এই বাড়িতে থাকতে শুরু করেন।।১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন,১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন,১৯৭০ সালের নির্বাচন,১৯৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন।। নানা চড়াই উৎরাই এর সাক্ষী এই বাড়ি।। বঙ্গবন্ধু পাখি ভালোবাসতেন। এই বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সময় থেকেই থাকা পায়রার খোপ এখনো আছে।পায়রা শান্তির প্রতীক।। পায়রা থাকা , সবুজ গাছে ঘেরা বাড়িটি প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনা।।যা ঘটেছিল ১৫ ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে।।আজও দেওয়ালে, দরজায়,কপাটে , মেঝেতে অজস্র বুলেটের ক্ষত।। রক্তের ছোপ লাগা পোশাক।।সব সাজিয়ে রাখা হয়েছে ঘরে ঘরে।।১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট এর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের নিদর্শন।।
অথচ এই বাড়ি থেকেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন ১৯৭১সালের ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে বাঙালীর স্বাধীনতা এখান থেকেই সেই রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল পাকিস্তানের সেনারা।। শেখ রেহানার ঘরের উল্টোদিকে সিঁড়ি।। যেখানে বঙ্গবন্ধু লুটিয়ে পড়েছিলেন গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে।। সিঁড়ির ধাপ গুলো বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল রক্তধারা।। সেই সিঁড়ি আজ চলাচলের জন্য বন্ধ।। পাশের দেওয়ালে ঝোলানো জাতীয় পতাকা।। ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা রক্ত গোলাপ গুচ্ছ।।
বাড়ির তৃতীয় তলায় শেখ কামালের কক্ষ।। বঙ্গবন্ধুর বড়ছেলে ছিলেন সংগীতানুরাগী।। তিনি তাঁর ঘরটি যেভাবে সাজিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই সাজানো আছে।। বিছানার পিছনে রয়েছে তাঁর সস্ত্রীক ছবি।। সামনে কার্পেটের উপর রাখা তানপুরা।।এক পাশে অর্গান।।শোকেসে সাজানো আছে শেখ কামাল এর সংগ্রহ করা বিভিন্ন গানের রেকর্ড।।সব অবিকল আছে শুধু মানুষগুলো নেই।। বাগানে তখন গাছের পাতা গুলো নির্বিবাদে ঝড়ে পড়ছিল।। মাঠের ঘাস বড় হচ্ছিল __