রাজ্য

চলে গেলেন সাহিত্যিক আজহারউদ্দীন খান (০১.০১.১৯৩০– ২২. ০৬.২০২১)


সেখ ইসরাইল: চিন্তন নিউজ:২৫শে জুন:– দীর্ঘ রোগ ভোগের পরে মেদিনীপুর শহরের বড় আস্তানার নিজের বাসভবনে ৯১ বছর বয়সে  প্রয়াত হলেন বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব আজহারউদ্দীন খান। ১৩ বছর আগে প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। নিয়মিত চিকিৎসা,চেকআপ ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ১৩ বছরের লড়াইয়ে হার মানলেন তিনি। গত কমবেশি  ৪ বছর ধরে প্রায় গৃহবন্দি ছিলেন। ধীরে ধীরে শরীরের শক্তি ও মস্তিষ্কের সক্রিয়তা কমে আসছিল। সপ্তাহ দুই- এক ধরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ২২ জুন রাত ১১ টা ৫০ মিনিট নাগাদ তাঁর জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর খবর পেয়ে সকাল থেকেই আত্নীয়সজনের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন সামিল হতে থাকেন।গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ ও গণনাট্য সংঘ এর নেতৃবৃন্দের মধ্যে  বিজয় পাল, বিমল গুড়িয়া, জয়ন্ত চক্রবর্তী, কামরুজ্জামান, প্রদীপ বসু,রবি বসু, স্বপন বেরা, বিদ্যুৎ পাল, উত্তম চক্রবর্তী, আবিদ বেগ প্রমুখ। সংগঠন দপ্তরে এসেছে অসংখ্য শোকবার্তা। তাঁর ছোটো ছেলে সুমন জানালেন জেলা তথা রাজ্য কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রাক্তন অগ্রণী প্রবীণ নেতা দীপক সরকার ফোন করে সমবেদনা জানান।
   
দুই  বাংলায় সাহিত্যচর্চায় আজহারউদ্দীন খান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাম। তাঁর সৃষ্ট  প্রবন্ধ  বাংলা  তুলনামূলক সমালোচনা  সাহিত্যের  মহাসম্পদ। আজহারউদ্দীন খানের জন্ম ১৯৩০ সালের ১লা জানুয়ারি, মাতামহ দাদ আলি খানের মেদিনীপুরের মীরবাজারের বাড়িতে। মা কামরুন্নেসা,বাবা খান উড়িষ্যা  কটকের বাসিন্দা  হলেও কর্মসূত্রে থাকতেন খড়গপুরে। মামার বাড়িতে  থেকেই  বড়ো হয়েছেন।  তাঁর  হাতেখড়ি  হয় বাড়ির মাতামহীর কাছে। ‘ বর্ণপরিচয় ‘ ১ম ও২য় ভাগ, ‘বোধোদয়’ পড়েছেন তাঁর  কাছে। মাতামহী  তাঁকে খুব  যত্ন করে উর্দু  কায়দা । অতঃপর পাঁচ বছর  বয়সে প্রাণকৃষ্ণ  রাণা-র পাঠশালায় ভর্তি  হন। মাসিক বেতন দু’ আনা। মাতামহীর আগ্রহে ১৯৩০ সালে কলেজিয়েট স্কুলের সর্বনিম্ন ক্লাস তৃতীয়  শ্রেণিতে  ভর্তি হন। এই স্কুলেই চতুর্থ  শ্রেণিতে পড়ার সময়েই রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন। ১৯৩৯ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বিদ্যাসাগর  স্মৃতি  মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন  করতে  এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছাত্র  অবস্থায় রবীন্দ্রনাথকে দেখা  এইভাবে  বর্ণনা  করেছেন,’রবীন্দ্রনাথকে দেখা  এক পুণ্য  সঞ্চয়।

রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি  দেখা  মেদিনীপুরের শেষতম ব্যক্তি  চলে গেলেন।  মাতামহীর আগ্রহে কানাই ভৌমিক  নামে একজন গৃহশিক্ষকের কাছে তিনি  পড়তেন। কানাই ভৌমিক  পরবর্তীকালে জেলার অন্যতম কমিউনিস্ট  নেতৃত্ব ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের  একাধিক দপ্তরের মন্ত্রী হন।কানাই ভৌমিকের প্রভাব  তাঁর  চরিত্রে স্থায়ীভাবে  ছাপ ফেলে যায়।কানাই ভৌমিক  চলে যাওয়ার সময় সম-মানসিকতার একজন বন্ধুকে তাঁর গৃহশিক্ষক  হিসেবে  যুক্ত করে দেন। এভাবেই  কৈশোর  থেকে তিনি কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন  হয়ে পড়েন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হননি কখনও।

১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে জুলাই মাসে আজহারউদ্দীন খান মেদিনীপুর  কলেজে  আই-এ তে ভর্তি  হলেন। আই -এ পাশ করে ১৯৪৮ সালে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৪৭ থেকে পাঠ্যবইয়ের থেকে অন্য বিষয়ের পড়াশোনা, পত্রিকা  প্রকাশ, নজরুল  সম্পর্কে  তথ্য তালাশ করতে গিয়ে পরীক্ষার  পড়া হয়ে  ওঠেনি।ফল যা হবার তা ই হয়েছে।বি.এ. পরীক্ষা  সম্পূর্ণ  করতে পারেননি।দু-একটা  পেপার পরীক্ষা  দেওয়ার পর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। বি.এ.পাশ না করেই কলেজ ছাড়া হন। আর এই সময় থেকে শুরু  হয় তাঁর  সাহিত্য প্রীতি। সাহিত্য সৃষ্টির  পূর্বে তাঁর প্রধান নেশা ছিল  বই পড়া। মুদ্রিত  আকারে তাঁর  প্রথম  লেখা  প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালের ২৯ জানুয়ারি রবিবারের ‘যুগান্তর সাময়িকী’তে—‘কবিদর্শনে’। যদিও  তিনি প্রথম  লেখাটি লেখেন ‘ মেদিনীপুরে রবীন্দ্রনাথ ‘।মেদিনীপুরের কলেজ পত্রিকাটি ১৯৪৯ সালের পরিবর্তে  প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৫০ সালে।তাই মুদ্রিত  হিসেবে  ‘কবি দর্শনে’ লেখাটি প্রথম  প্রকাশিত রচনার মর্যাদা  পেয়েছে। ১৯৫০ সালের যুগান্তর সাময়িকী-র রবিবারে  ‘কায়কোবাদ ‘ এবং এস.ওয়াজেদ  আলিকে নিয়ে দুটি লেখা প্রকাশিত  হয়।
       
সোশ্যাল ক্যাডার শিক্ষক হিসেবে  আজহারউদ্দীন খান ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে ‘আঁধারনয়ন জুনিয়র হাই স্কুলে ‘ যোগ দেন মাসিক ৮০টাকা বেতনে। এই কাজ তাঁর  পছন্দ  ছিল না। শহর ছেড়ে গ্রামে থাকা, নিজের  পড়াশোনার  কোন সুযোগ  না পাওয়াই ছিল  এর প্রধান কারণ। আঁধারনয়নে সেই  সময় কোন ডাকঘর ছিল না। এই সময় তাঁর  প্রথম  গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বাংলা  সাহিত্যে  নজরুল’ প্রকাশের কাজ চলছে কোলকাতায়। আটটি প্রবন্ধ  নিয়ে ডিমাই  সাইজের ২১২ পৃষ্ঠার বই মে মাসে  প্রকাশিত  হল। বর্তমানে  পুস্তকটি ৭ম সংস্করণে ২১ টি প্রবন্ধ নিয়ে রয়াল সাইজে  ৮৫০ পৃষ্ঠার।পুস্তকটি দুই বাংলায় নজরুল চর্চার অন্যতম প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হয়। এখান  থেকে কোলকাতার  সঙ্গে  যোগাযোগ করাও কষ্টসাধ্য হচ্ছিল। সুযোগ  খুঁজছিলেন মেদিনীপুরে চলে আসার।অচিরেই মনের মতো কাজের সুযোগ এল।বিজ্ঞাপন  পড়ে :মেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগারে কর্মী নেওয়া হবে। আবেদন  করলেন কর্মপ্রার্থী হিসেবে। মনোনীত  হয়ে ১৯৫৭ সালের আগস্ট মাসে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে কাজে যোগ  দিলেন।কাজের সঙ্গে প্রচুর  বই পড়ার অফুরন্ত  সুযোগ। জ্ঞানের দরজা  হল অবাধ উন্মুক্ত। জেলা গ্রন্থাগারে কাজ করতে  এসে ১৯৭২ সালে বি.এ.এবং  ১৯৭৭ সালে কোলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়  থেকে পাশ করলেন। অবশ্য ১৯৫৯ সালে বেঙ্গল  লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশন  থেকে Lib.Sc.সার্টিফিকেট কোর্স  করেন।
    
পঞ্চাশের দশক থেকে তিনি লিখেছেন। দীর্ঘ ষাট বছরের সময় কালে তিনি প্রায় দেড়শতাধিক মূল্যবান  প্রবন্ধ  লিখেছেন। রচনা করেছেন ১৭টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ গ্রন্থ। পনেরোটি গ্রন্থ  ও তিনটি পত্রিকা  সম্পাদনায় তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত  ছিলেন। লিখেছেন তেত্রিশটি গ্রন্থের ভূমিকা। দশ জন লেখক দশটি গ্রন্থ তাঁকে উৎসর্গ করেছেন। সাহিত্যিক আজহারউদ্দীন খানের লেখার বৈশিষ্ট্য প্রধানত সাহিত্যচর্চায় যে সমস্ত দিক অনালোচিত  বা যেসব প্রতিভাবান সারস্বত  ব্যক্তি  সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ  আলোচনা গ্রন্থ রচনায়  কেউ উৎসাহবোধ করেননি সেসব বিষয়ে তিনি গবেষণামূলক বই লিখেছেন —–
‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ ‘বাংলা সাহিত্যে মোহিতলাল’  ‘বাংলা সাহিত্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’ ‘বাংলা সাহিত্যে মুহম্মদ  আবদুল হাই ‘ ‘গ্যেটে ও বাংলা সাহিত্য’ ইত্যাদি। ‘বিলুপ্ত হৃদয়’ (মীর  মোশাররফ হোসেন,মোজাম্মেল হক্ প্রমুখের জীবনী), ‘রক্তাক্ত  প্রান্তর’ (মুনীর চৌধুরী), ‘মাঝ নিশীথের  কোকিল'(আবদুল  করিম সাহিত্য  বিশারদ), ‘অফুরন্ত রৌদ্রের তিমির'(শাহাদাৎ  হোসেন), ‘মেধাবী  নিলীমা”(মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্), ‘দীপ্ত  আলোর বন্যা’,(আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মুহাম্মদ  শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী)।  লিখেছেন —–‘সাহিত্য  সাধনায়  বিদ্যাসাগর’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র  অন্য ভাবনায়’।  দু’পার বাংলায় নানাবিধ সাহিত্য  পুরস্কারে সম্মানিত  হয়েছেন—–নজরুল  পুরস্কার (১৯৮২),মুহম্মদ আবদুল হাই  পুরস্কার (১৯৮৩) বাংলাদেশ,  বঙ্গীয় সাহিত্য  পরিষদ (১৯৯৭),নজরুল পুরস্কার(২০০৩) পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ২০০৭ সালে বিদ্যাসাগর  বিশ্ববিদ্যালয়  কর্তৃক ডি.লিট.(D.Lit.) সাম্মানিক।১৯৮৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক  লেখক শিল্পী সংঘের সভাপতি (আমৃত্যু), ১৯৮৯ —- ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজ্য কমিটির অন্যতম সহসভাপতি  ছিলেন। সংগঠনের সাহিত্য মুখপত্র ‘ শব্দের মিছল’ পত্রিকার সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেছেন একাদিক্রমে ৩৬ বছর। ২২শে জুন মৃত্যুকালে রেখে  গেলেন স্ত্রী  হাসনা বানু ও দুই  পুত্র আরিক খান(দীপন) আরিফ খান(সুমন) কে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা ‘প্রবন্ধ’ সাহিত্যে বড়ে শূন্যস্থান তৈরি হল।


    


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।