কলমের খোঁচা

বাতিঘর বিদ্যুৎ দত্ত.


চিন্তন নিউজ:৪ঠা মে:- আজ তোমাদের সপ্তক আর শ্রীলেখার গল্প শোনাব । সপ্তক সরকার আর শ্রীলেখা মিত্র । মেঘ আর বৃষ্টির মতো ওদের নিবিড় সম্পর্ক । ওরা কোন প্রেমকাহিনীর নায়ক-নায়িকা নয় । ওরা ছিন্নমূল পরিযায়ী শ্রমিকের প্রতিনিধি ‌। পেটের তাগিদে ওরা ঘর ভুলেছে । ওদের গন্তব্য কখনো সুরাটের বস্ত্রবয়ন শিল্পে, কখনো মুম্বাইয়ের স্বর্ণশিল্পে, কখনও চেন্নাই কিংবা কেরালায় নির্মাণ শিল্পে । ওদের কোন ঠিকানা নেই । ওরা কর্মপ্রবণ । তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওরা কাজ করে । কর্মশেষে ওরা আশ্রয় নেয় খোলা আকাশের নীচে । বাড়িতে চিঠি লেখে । কুশল সংবাদ প্রেরণ করে । ডাকযোগে টাকা পাঠায় । ঐ টাকায় বেঁচে থাকে পরিবার । ওরা কাজ করে মাঠে ঘাটে, নগরে প্রান্তরে । ওদের উত্তরণ কৃষক থেকে শ্রমিকে, অদক্ষ কর্মী থেকে দক্ষ কর্মীর মধ্যে । ওরা প্রত্যক্ষ করে কঠোরতা আর কর্কশতাকে । এর ই নাম সভ্যতা । কাজে যেতে দেরী হলে ওদের অসম্মানিত হতে হয় । পরিযায়ী শ্রমিকদের মান-সম্মান থাকতে নেই । ওদের ঘরে চাল নেই, মাথার উপর ছাদ নেই, আত্মীয়তা নেই- এমনকি শরীর খারাপ হতে নেই । ওরা নির্দিষ্ট কোন রাজ্যের সীমানায় আবদ্ধ নন । ওরা নেই রাজ্যের বাসিন্দা । ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ বোঝে ওদের অসহায়ত্ব । তাই সুযোগ খোঁজে বেশী । ওরা কোন ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে । ঠিকাদার নিঃশব্দে ওদের মাথা থেকে মোটা অঙ্কের উপার্জন করে । তারপর কোন এক সময় ওদের বিদেশে কাজ করতে পাঠিয়ে অনেক বেশি মুনাফা অর্জন করে ঠিকাদার । কিন্তু অন্ধকারে ঢেকে যায় এই সকল হতভাগ্য শ্রমিকদের জীবন । পরিযায়ী পাখি প্রতিকূল পরিবেশকে উপেক্ষা করার জন্য সাত সমুদ্র তের নদী পার হয় । আসলে প্রাণ যে আশ্চর্য সম্পদ । তাই শ্রমিকরা একমুঠো আলোর সন্ধানে দেশান্তর হয় । কিন্তু সৌভাগ্যের সূর্যোদয় কজনের হয় । বেশীরভাগের ভাগ্যাকাশ দুর্ভাগ্যের কালোমেঘে ঢেকে যায় । অথচ ওদের পরিবার পরিজন বছরভর ওদের পথ চেয়ে থাকে । তারপর একদিন গ্ৰামে ফিরে ওরা ভালো থাকার সুনিপুণ অভিনয় করে । অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকের মধ্যে রেখে ওরা পরিবারের মানুষের হাসি বজায় রাখে । তারপর একদিন ট্রেনের সাধারণ কামরায় কর্মস্থলে ফেরে । রাত্রি জাগরণ ওদের অসুস্থ করে তোলে । সেই করুণ কাহিনী অনুভব করা বড় কঠিন । এভাবে ই একদিন সপ্তকের জীবনের সুর কেটে যায়, শ্রীলেখার লেখনীতে ধার নষ্ট হয় । তবুও ওরা কাজ করে…….

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ওদের জীবনবোধ স্পষ্ট হয় । এদেশের উঁচু তলার মানুষ ওদের যথার্থ মূল্যায়ন করেনি । এই থমকে যাওয়া সময়ে ওরা বাতিল নোটৈর মত ই মূল্যহীন । অথচ এদেশে ঘটা করে মে দিবস উদযাপিত হয়েছে । বক্তব্যে শ্রমজীবি মানুষের জয়গান । আবার অন্য দিকে করোনা আবহে অনাহারে অর্ধাহারে দিনযাপন করছেন দেশের শ্রমজীবি মানুষ- আধুনিক সভ্যতার যথার্থ রূপকার । কেউ খবর রাখে না । বাধ্য হয়ে রেলপথ ধরে হেঁটে প্রত্যাগমন । শিশু,বৃদ্ধ, নরনারী হেঁটে চলেছেন এক অজানার দিকে । সভ্যতার চোখে জল নেই । ওরা এই কয়েক দিনে যে পথ হেঁটেছেন আমরা সারা জীবন ঐ পথ হাঁটতে পারব না । অথচ দেশের পুঁজিপতিদের ঋণ মকুব হয়েছে কিন্তু ওদের সসম্মানে রাজ্যে ফিরে আনা যায় নি । এ বড় লজ্জার । ওদের নিয়ে সহজেই রাজনীতি করা যায় । তাই ওদের জন্য কোন বাতিঘর নেই । তাই সপ্তক- শ্রীলেখা- মেহেবুব- আমিনারা আলোর সন্ধান করে চলেছেন । ঐ আলোকচ্ছটায় কালো মুখ গুলো দেখতে চাই সভ্যতাগর্বী জয়োদ্ধত তথাকথিত সুশীল সমাজকে ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।