কলমের খোঁচা

মহান দার্শনিক কার্ল মার্কস , চির ভাস্বর ইতিহাসের স্রষ্টা — সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:৫ই মে:–চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও
লিখে দিতেন, ‘পৃথিবী ঘুরছে না’।
পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবেও
যতই তাকে চোখরাঙাও না।
( পৃথিবী ঘুরছে- বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
“… Imperialist propaganda offensive sought to depict that socialism is dead, communism has no future and that capitalism is the last stage in the evolution of human society. Its paid scribes sought to negate the history of the last 150 years, that had seen the discoveries of Marx shedding a new light on philosophy, political economy and the social science.The study and works of Marx that brought a hitherto unknown approach on understanding and comprehending contrmporary developments, were sought to be challenged.” (Introduction: Harkishan Singh Surjeet, International Seminar of Communist Parties Marking The 175 Birth Aniversary of Karl Marx- Organished by The CPI-M)
“CHALLENGE”বেপথু হয়েছে, গতি ও উৎসাহ হারিয়ে স্তিমিত হয়েছে, নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আনন্দ বিগলিত উল্লাস তাও ক্রম ম্রিয়মাণ, ক্ষীয়মাণ, কারন সাময়িক মধুচন্দ্রিমা কাটিয়ে এককেন্দ্রিক বিশ্বের অধিশ্বর “CAPITALISM” এখন নিজেই “GREAT DEPRESSION”য়ে। কিন্তু তবু মার্কসের জন্মের দুশো বছর পরেও তার চিন্তাশৈলীকে ইতিহাসের আবর্জনায় বা কষ্টকল্পিত ভুলে যাওয়া এক বাতিল অধ্যায়ে পর্যবসিত করার ক্লান্তিহীন কেরামতিতে ছেদ পড়েছে তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। মার্কসীয় সামাজিক গতির তত্ত্ব, “যেখানে বিশ্বাসের প্রকাশ বিজ্ঞানের সূত্র ধরে” সেখানেই পুঁজির কদর্যতার কাছে, মুনাফা শুধু মুনাফার নৃশংস লালসার কাছে সমাজ বিকাশ-বিশুদ্ধতার মূল চালিকাশক্তি শ্রমের নিরুপায় আত্ম সমর্পণের “বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই” ভাড়াটে পন্ডিত প্রবরদের তাকে নস্যাৎ করার প্রাণপণ অপচেষ্টা অতএব চলতেই থাকবে। তাই চিন্তার জগতে অভূতপূর্ব ‘ অপরূপ-আশ্চর্য কর্মকুশলতার’ অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক, পৃথিবীর শোষিত-বঞ্চিত- নিপীড়িত শ্রমজীবি জনতার হৃদয়ে চিরজাগ্রত, প্রতিদিনের গ্রাসাচ্ছাদনে লড়ে যাওয়া জীবনের উন্মুক্ত চেতনা মহান দার্শনিক কাল মার্কসের ২০৩ তম জন্মদিবসে তার অভ্রভেদী অবয়বের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা যখন মাথা উঁচু করে উচ্চারণ করবো,“প্রেত নয়: রাঙাপ্রাণের মশালে / আঠার শ অাটচল্লিশ সালে / সর্বহারার চেতনায় জাগা ঘুম / প্রেত নয়: ওরা সারা দুনিয়ার / বিপ্লবী মহাপ্রেম পারাবার / গণ মানবের রক্তের মহাধুম…” ( কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো শতবার্ষিকী- বিমলচন্দ্র ঘোষ) তখন মুহূর্তের জন্যেও একথা বিস্মৃত হওয়ার অধিকারী আমরা নই যে, “ একটি আদর্শের ভাস্বর প্রতীক, যে আদর্শ অব্যয়, যে আদর্শ ঘোষণা করে বহুতর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়ে মানুষ একদিন শ্রেণীহীন, সংঘাতহীন অমরাবীতে পৌঁছাবে। যেখানে সে, পরিণতির উপান্তে মহত্তম, বৃহত্তম, উদারতম” (অশোক মিত্র- প্রবন্ধ সংকলন পৃঃ ১৯ )—মার্কস কিন্তু সমষ্টি মানুষকে শ্রেনীচেতনার কল্পনাশ্রয়ী নিরপেক্ষতার অনির্ভরশীল ‘আশ্রয়’ থেকে মুক্তি দিয়ে পরস্পর বৈপরীত্যের দ্বান্দিকতার পথে বহমান করে পুনরুজ্জীবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেই নিশ্চেষ্ট হয়ে যাননি। ১৭৬০ সালের শিল্প বিপ্লব, ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লব- এই দ্বৈত বিপ্লব (Dual Revolution), ১৮১৯ সালে ইংল্যান্ডের ‘ পিটারলু’তে ব্রিটিশ শ্রমিক দের নির্বিচারে হত্যা, ১৮৪৮ সালে প্যারিসের রাজপথে ফরাসী শ্রমিকদের রক্তাত্ব প্রতিরোধ, ১৮৭১ সালে ঐতিহাসিক প্যারী কমিউন ইত্যাদি ঘটনা সমূহের গভীর পর্যবেক্ষণে উদ্ভাসিত মার্কস, সেই সময়েও ক্লীবের কুৎসিত উপহাসে, উপেক্ষায়, অবজ্ঞায় দীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত স্বয়ং মার্কস এতদসত্ত্বেও নিজেও এমনকি অচিরেই বঞ্চিত, লাঞ্ছিত জীবনের শোষনের আগল মুক্ত হওয়ার সংগ্রামের বন্ধুর, কন্টকাকীর্ণ পথের ক্লান্তিহীন পরিব্রাজক হয়ে উঠেছিলেন। কারন,তারমতো মানবসভ্যতার ইতিহাসের নতুন আলোকজ্জ্বল পথের দিশারি, ক্লান্তিহীন পদাতিক, পৃথিবীর সব দুঃখ,কষ্টের বোঝা বইবার, সইবার ইতিহাস প্রদত্ত বিশ্ব মানবমুক্তির ভারপ্রাপ্ত মানবতাবাদীর পক্ষে বোঝা কঠিন ছিলো না,“দ্বান্দ্বিক নিয়ম মিথ্যা হওয়ার নয়” তাই বলে “ হাত গুটিয়ে বসে থাকলে অবশ্য দ্বান্দ্বিক নিয়ম স্বয়ংক্রিয় হবে না, করুণ গলায় এ-আঁধার-হবে-ক্ষয় গোছের কীর্তনকর্তনেও হবে না।” আজ তার জন্মের দুটো শতাব্দী পার করে এসে সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া আসলে রক্ত নিষ্কাশনের প্রকার পদ্ধতি বদলে ফেলা পৃথিবীরটার দিকে একটু চোখ ফেরালেই কত সহজে বোঝা যায় ‘সত্য যে কঠিন’। “বিজ্ঞান ও বিশ্বাস, আবেগ ও বুদ্ধি, চিন্তা ও অনুকম্পা পরস্পরের সঙ্গে নিবিড় হয়ে মিশে গেছে। মানবসমাজের সম্পূর্ণ বিবর্তনের ইতিহাস এভাবে এক নিটোল-নিবিড় যুক্তি শৃঙ্খলার নিগড়ে বন্দী ক’রে আনা ব্রহ্মপ্রতিম কারুকীর্তি” (অশোক মিত্র-প্রবন্ধ সংকলন, পৃঃ১৬)-এই কীর্তিকে,এইমহান কীর্তির সত্যকে, সত্যের স্রষ্টা কার্ল মার্কসকে অতএব নিশ্চিহ্ন করাতো দূরস্থান সামান্য নীরব করাই কঠিন। স্বপ্নভাঙা তাই বুকভাঙা আর্তনাদে স্থপতি মহামতি লেনিনের সর্বহারার সব পাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষুধা হরণের উদাহরণ,- পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েতের পতন, পূর্ব ইউরোপে সমাজবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া দিয়ে যে বিম্বিশা’র শুরু তা ক্রমে হয়ে উঠলো মার্কস, মার্কসবাদ ও তার মর্মবস্তু সমাজতন্ত্রকে অনন্ত কালের জন্যে নিশ্চিহ্ন করার হিংস্র গর্জন। পথ নাই আর পথ নাই, সব পথ এসে মিসে গেছে যেন পুঁজির দাসত্বে। মার্কসবাদী প্রজ্ঞায় প্রাণিত আমরাও কেমন যেন মার্কসীয় দর্শনের, তার প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্নে হতচকিত বা সাময়িক কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অথচ মার্কস তো “দেবদূত” নন। তার চিন্তা তো হঠাৎ স্বপ্নে পাওয়া কোনো সর্বরোগহরা মাদুলি নয়। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত থেকেই মার্কসবাদের সৃষ্টি ও বিকাশ। সত্য ও যুক্তি বিবর্জিত উগ্র মার্কসবাদ বিরোধীতা বা শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টিকোন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে মার্কসকে বিমূর্ত “উদারনৈতিক মানবতাবাদী” বানিয়ে তোলা এই রকম কোনো ভাবেই মার্কসকে আত্মস্থ করা সম্ভব কী ?। “ মার্কসীয় চিন্তাধারা শুধুমাত্র একটি ভিন্নধর্মী ঐতিহ্য মাত্র নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী জীবনদর্শনও”
(শোভনলাল দত্তগুপ্ত- মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তা) অতএব স্বপ্নদ্রষ্টা মার্কসের সৃষ্টিশীলতা ও তার প্রয়োগকে যদি বিজ্ঞান ও বিশ্বাসের সংশ্লেষণে সময়ের নিরিখে গভীর অনুসদ্ধিৎসায় অনুধাবন করার কাজে আন্তরিক হওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে মার্কসবাদের বিশ্বব্যাপী অন্তর্জলি যাত্রার প্রাণান্তকর চেষ্টার এই পরিমন্ডলেই মার্কস ও তার চিন্তাধারা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে, এমনকি সমাজতন্ত্রের “স্বর্ণযুগের” সময়ের চেয়েও আজ বেশী করে প্রাসঙ্গিক। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা, সেই উৎপাদন ব্যবস্থা অনুসারী রাষ্ট্র ব্যবস্থা অতএব আদ্যপ্রান্ত শোষণ ভিত্তিক। সম্পদের চূড়ান্ত অসম বন্টন, রাষ্ট্রীয় বিচারধারায় ধনী দরিদ্রের প্রকটতর বৈষম্য তার অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট হাজারো কৌশল ব্যবহার করেও এর বাইরে পুঁজিবাদ বেরোতে পারবে না, সংকটাদীর্ণ তাকে হতেই হবে। পারছে কী ?পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পুজির অবাধ চলাচলের পথ মসৃন করে, সব কটি তথাকথিত “নিরপেক্ষ” আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দাসানুদাসে পরিণত করে, উত্তর আধুনিকতা বা উত্তর সত্যের নামে প্রযুক্তির যথেচ্ছ অপব্যবহারে বিকৃত, অতি বিকৃত তথ্যের, আসলে মিথ্যার একচেটিয়া সাম্রাজ্য স্থাপন সম্পন্ন করে, সারা দুনিয়া জুড়ে ভয়াবহ যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি করে, লুঠের শুধু লুঠের লালসায় বিশ্ব প্রকৃতির বেপরোয়া ধ্বংস সাধনকে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত করে এমনকি শেষ রক্ষাকবচ ঠাউরে উগ্র জাতীয়বাদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিকে রাষ্ট্রীয় পরিচালন ব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদানে পরিণত করেও বাঁচবার পথ খুঁজে পাচ্ছে কী পুঁজিবাদ ? অসহনীয় বেকারী, মজুরী ও সব রকম সামাজিক সুরক্ষায় কোপ, ব্যাপক ছাঁটাই এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরে সীমাহীন দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আজ সভ্যতার শেষ সিঁড়ি পুঁজিবাদের মুকুটের শোভাবর্ধক একেকটি পালক। পুঁজিবাদী দুনিয়া বেসামাল গণ অসন্তোষে, একি শুধু গল্প গাথা ? নাকি নিত্যকার সত্য। আমাদের দেশ? রাজ্য ? ( বিস্তৃত ব্যাক্ষা এখানে নিষ্প্রোজন) তাও কি এসত্যের প্রতিবিম্ব নয় ? অতএব, চিল চিৎকার চলবে। কিন্ত পৃথিবী মহান দার্শনিক কার্ল মার্কসকে মনে রাখবে চির ভাস্বর ইতিহাসের স্রষ্টা হিসাবেই।
———————


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।