গোপা মুখার্জী : চিন্তন নিউজ :২৭শে জুন:- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্য জগতের একজন যথার্থ শ্রেষ্ঠ শিল্পী । উনবিংশ শতাব্দীর এক বিশেষ লগ্নে ‘বঙ্গদর্শনের’ সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব । অসাধারণ পাণ্ডিত্য, অবিচল নিষ্ঠা এবং সুগভীর জীবন বোধ এই তিনের সহায়তায় তিনি তৎকালীন অখণ্ড বাংলার রাজনীতি, সমাজনীতি , বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প -সংস্কৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প কবিতায় ।দীর্ঘদিন প্রশাসনের কাজে যুক্ত থাকার ফলে মানুষের খুব কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি ।কাজেই বাংলা এবং বাঙালি কে উত্তরণের কাজে তাঁর বিজ্ঞান মনস্ক এবং যুক্তিবাদী মন সতত ছিল যত্নশীল ।
বিজ্ঞান বিষয়ে বঙ্কিমের বিশেষ আগ্রহের কথা আমরা জানতে পারি তাঁর বয়স্যদের স্মৃতি কথা থেকে ।’বঙ্গদর্শন’ প্রকাশের পূর্বে তিনি যখন বারুইপুরের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তখন কার স্মৃতি কথা লিখতে গিয়ে রেজিস্ট্রি অফিসের তৎকালীন প্রধান করণিক কাশীনাথ দত্ত লিখেছেন কিভাবে বঙ্কিমচন্দ্র অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কীটাণু , পুষ্করিণীর দূষিত জল, উদ্ভিদের সূক্ষ্ম ভাগ এবং জীবশোণিত প্রভৃতি সূক্ষ্ম পদার্থ জাতির পরীক্ষা করতেন। তিনি আরও বলেছেন, ” এই সমস্ত পরীক্ষার সময় আমি কখনো তাঁহার মধ্যে ঈশ্বর ভক্তির অপার উচ্ছ্বাস দেখি নাই ।”
বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে দেশের উন্নতির জন্য আধুনিক বিজ্ঞান চর্চা অত্যন্ত জরুরি এবং তা শুধুমাত্র গুটিকয়েক উচ্চ শিক্ষিত বৈজ্ঞানিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না ।বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বসাধারণের মধ্যে । এই কারণেই তিনি বঙ্গদর্শনের পাতায় বিজ্ঞানের নানা জটিল বিষয় সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ করতে শুরু করেন ।
বঙ্গদর্শনের দ্বিতীয় সংখ্যাতেই বঙ্কিম দুটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ‘স্যার উইলিয়াম টমসনকৃত জীব সৃষ্টির ব্যাখ্যা ‘ এবং ‘আশ্চর্য সৌরৎপাত’ । এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বঙ্গদর্শনের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সঙ্গীত ‘ প্রবন্ধ টিও তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ ।বর্তমানে ভারতের অধঃপতনের কারণ আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি অবহেলা ।বঙ্কিম লিখলেন, ” বিজ্ঞানের সেবা করিলে বিজ্ঞান তোমার দাস , কিন্তু যে বিজ্ঞানের অবমাননা করে , বিজ্ঞান তাহার কঠোর শত্রু ।” তিনি বীজগণিত, মিশ্রগণিত , রসায়ন, উদ্ভিদ বিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি সঙ্গীতেরও বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা করেছেন ।আলোচনা করেছেন শব্দ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়েও। ভারতে বিজ্ঞান সভা স্থাপনের জন্য তিনি মুক্ত হস্তে দান করার আহ্বান জানিয়েছেন ।বিজ্ঞান বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র অনেক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ,কবিতা লিখেছেন ।’বায়ু’ কবিতায় তাঁর বিজ্ঞান সুলভ দৃষ্টি ভঙ্গির পরিচয় পাই …….
” কে বাঁচিত এ সংসারে আমার বিহনে?/ আমি না থাকিলে ভুবনে? / আমিই জীবের প্রাণ / দেহে করি অধিষ্ঠান, /নিঃশ্বাস বহনে ।”
এরপর পরের সংখ্যাতেই লিখলেন ‘আকাশে কত নক্ষত্র আছে ‘ । আলোচনা করলেন কোন নক্ষত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর, কতই বা দূরবীক্ষণে ধরা পড়ে । তিনমাস বাদে ফাল্গুন সংখ্যায় লিখলেন ‘ধূলা’ ।” যে জল স্ফটিক পাত্রে রাখিলে বৃহৎ হীরক খন্ডের ন্যায় স্বচ্ছ বোধ হয় , তাহাও কীটাণুপূর্ণ ।” যে সময়ে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত জানতো না ভাইরাস কি , তাদেরও ধারণা ছিল ম্যালেরিয়া হয় পচা ডোবার দূষিত জল থেকে ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো একজন সাহিত্যিকের পক্ষে জীবাণুর কথা জানা সত্যিই আশ্চর্যের । বিজ্ঞান মনস্ক ও রেশানালিষ্ট বঙ্কিম চিন্তা ও অধ্যয়নের জেরে সত্যের অনেক কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
বিজ্ঞানের প্রবন্ধই লিখুন বা ঐতিহাসিক নিবন্ধ বা উপন্যাস সর্বত্রই মানুষের মঙ্গল চিন্তা তাঁকে ধাওয়া করেছে ।বলা বাহুল্য, দেশের হাজার লোকের মধ্যে ন’শ নিরানব্বই জনের জন্যই তিনি কলম ধরেছিলেন । এ প্রসঙ্গে ‘চঞ্চল জগৎ’ , ‘গগন পর্যটন ‘ ইত্যাদি প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য।
আজকের দিনে আমরা জনপ্রিয় বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি সে ধারণা বঙ্কিম যুগে ছিল না ।বঙ্কিমচন্দ্রের একটি অন্যতম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ‘পরিমাণ রহস্য ‘ । এখানে তিনি সমুদ্রের গভীরতা, শব্দের গতি, জ্যোতি তরঙ্গ, সমুদ্র তরঙ্গ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন ।লিখেছেন, পৃথিবীর ব্যাস ৭০৯১ মাইল। ৩৫ এর পর ২৬ টি শূন্য দিয়ে বুঝিয়েছেন, কতগুলো বাতি জ্বাললে সূর্যের সমান তাপ হতে পারে ।
সাধারণ মানুষের সুখ- দুঃখ, হাসি -কান্না, ভালো -মন্দ সমস্ত খুঁটিনাটি তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে এবং তা তিনি ইতিহাসের উপাদান বলে মনে করেছেন ।যা তাঁর বৈজ্ঞানিক ও প্রগতিশীল চিন্তারই পরিচায়ক।
এ হেন যে প্রতিভা তার সঠিক মূল্যায়ন কিন্তু আজও হয়নি ।রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিম সম্পর্কে বলেছেন, ” তিনি ভগীরথের ন্যায় সাধনা করিয়া বঙ্গসাহিত্যে ভাব মন্দাকিনীর অবতারণা করিয়াছেন এবং সেই পূণ্য স্রোত স্পর্শে জড়ত্ব শাপ মোচন করিয়া আমাদের প্রাচীন ভস্ম রাশিকে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছেন……ইহা কেবল সাময়িক মত নহে …….ইহা একটি ঐতিহাসিক সত্য ।”
কিন্তু সেই সত্য আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।রবীন্দ্রনাথের এই মূল্যায়ন আমরা পড়েছি মাত্র কিন্তু তা অন্তরে উপলব্ধি করতে পারিনি ।আর তা পারিনি বলেই বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর শত বৎসর পরেও তাঁর যথার্থ মূল্যায়নে আমরা অক্ষম ।