কলমের খোঁচা

লেনিন এর ছেলেবেলা


রঞ্জন মুখার্জী:চিন্তন নিউজ:২২শে এপ্রিল:–“লেনিন” নাম নিয়েছিলেন অনেক পরে ছদ্মনামে লিখতে গিয়ে। ছোটবেলায় নাম ছিল ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ। ডাকনাম ভোলোদিয়া।
বাবা : ইলিয়া নিকোলায়েভিচ উলিয়ানভ।
মা : মারিয়া

লেনিন রা ছিলেন ৬ ভাই বোন।
ছটি ভাই বোন আর বাবা-মা, এই আটজনকে নিয়ে উলিয়ানভ পরিবার। ভাই বোনদের মধ্যে সকলের বড় আনা, সকলের আদরের দিদি । তারপরে আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডার আর আনা একই সময়ে গিয়েছিলো সেন্ট পিটার্সবুর্গে পড়তে। আলেকজান্ডারের পর ভ্লাদিমির। পরবর্তী কালে র লেনিন । তারপরে ওলগা। প্রায় পিঠাপিঠি ভাইবোন । ওলগা – র পরে আরো একটি ভাই, দমিত্রি। তারপরে আরো একটি বোন মারিয়া।ভলোদিয়া – র চোখ দুটো ছিল বাদামি আর দুষ্টুমি ভরা। এক মুহুর্ত স্থির হয়ে থাকতে পারত না। ছটি ভাই বোনের মধ্যে ওর দিকেই নজর পড়ত সকলের আগে।

ছোট বোন ওলগা ছিল ওর খেলার সাথী, কিন্তু কি খাবে, কি পরবে, কেমন ভাবে চলবে, চোখের সামনে তার আদর্শ ছিল বড় ভাই আলেকজান্ডার। যেকোনো প্রশ্নের মুখে সে চেয়ে থাকত তার বড় ভাই আলেকজান্ডারের চোখের দিকে। আলেকজান্ডার কি বলবে তার ওপর নির্ভর করত সিদ্ধান্ত নেওয়া । শুধু খেলা বা খাওয়ার ব্যাপারে নয়, প্রত্যেকটি ব্যাপারে ভ্লাদিমির হতে চাইত আলেকজান্ডারের মত । করতে চাইত আলেকজান্ডার যা করে ঠিক তাই। এই আলেকজান্ডারের কাছেই ভ্লাদিমির সর্বপ্রথম মার্কসবাদী সাহিত্যের কথা শোনে। এই আলেকজান্ডারের হাতেই ভ্লাদিমির সর্বপ্রথম মার্কসের ক্যাপিটাল বইটি দেখে।
আর আলেকজান্ডার ও নিতান্ত সাধারণ ছেলে ছিল না। অনেক গুণ ছিল তার। আলেকজান্ডারের অসাধারণ গুণ ছিল এই যে, সে কোন কিছু হালকাভাবে নিত না। গভীরভাবে ভাবত। তার ছিল প্রখর কর্তব্যবোধ।

ভ্লাদিমির ছিল একেবারে লক্ষণ ভাইটি, কিংবা তার চেয়েও বেশি। দাদা ছাড়া আর কিছু জানতো না । আর দাদাকে সম্পূর্ণভাবে কপি করত। দুভাইয়ের পড়াশোনা, খেলাধুলা সবই চলতো একসাথে । দুভাই ছিল দাবা খেলার পাকা খেলোয়াড়। স্কুলের লেখাপড়া তেও ভ্লাদিমির এর ছিল একান্ত মনোযোগী ছাত্র । মনোযোগী ও পরিশ্রমী। পড়া তৈরি করত নিখুঁতভাবে। অখন্ড ছিল তার মনোযোগ। পড়ার সময় কেউ বিরক্ত করলে বা স্কুলের বন্ধুরা এসে ডাকাডাকি করলে হাত জোড় করে বলতো
” আমি তোমাদের কাছে একটা ভিক্ষে চাইছি দেবে ?”
কি চাইছিস ? বল।
“এখানে তোমাদের অনুপস্থিতি”।

শৃঙ্খলা ,পরিকল্পনা, মনোযোগ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যাবসায়, সবকটা গুণের সমাহার ছিল ভ্লাদিমির এর গুণ এর ক্ষেত্রে। শুধু লেখাপড়ায় নয়, স্বভাবে ও চালচলনেও। কোন কাজে হার মানত না । সহপাঠী দের সাথে ব্যবহার ছিল সরল ও আন্তরিক। তাই বলে, ভালো ছেলে বলতে যে এক ধরনের মিনমিনে , মেরুদণ্ডহীন, পড়ার বইয়ের বাইরের জগত সম্পর্কে নিস্পৃহ , গোবেচারা, ধরনের জীবকে আমরা বুঝে থাকি, ভ্লাদিমির কোনক্রমেই সেইদলের ছিলনা। বই পড়ত প্রচুর, পড়ার বইয়ের বাইরেও। বাইরের জগত সম্পর্কে ছিল অতিমাত্রায় সচেতন, যা শুধু তার ভাবনার জগতকে ই আলোড়িত করত না, কর্মেও তাকে উদ্বুদ্ধ করত।

ভ্লাদিমির এর বয়স যখন মাত্র ১৬, তাকে পেতে হলো জীবনের প্রথম বড় আঘাত। ১৮৮৬ সালের জানুয়ারি মাসে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে বাবা মারা গেলেন। এই আঘাত সামলে উঠতে না উঠতেই ১৮৮৭ সালের পয়লা মার্চ তারিখে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার কে হত্যার চেষ্টার জন্য সেন্ট পিটার্সবুর্গে গ্রেপ্তার হলো দাদা আলেকজান্ডার । অল্প কিছুকাল পরে আনাও।

১৮৮৭ সালের ৮ ই মে তারিখে জার এর জল্লাদদের হাতে আলেকজান্ডারকে প্রাণ দিতে হলো । দাদার মৃত্যুর একমাস পরে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল ভ্লাদিমির কে। দুটি মৃত্যুর স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পরীক্ষা দিয়েও পাস করল সেরা নম্বর পেয়ে । অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও ভ্লাদিমির শেষ পর্যন্ত ভর্তি হতে পেরেছিল কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
ভ্লাদিমির এর প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিলেন পুশকিন, লেরমন্তফ, গোগোল, তুর্গেনেভ, নেক্রশফ, সালতিকভ- শেড্রিন ও তলস্তয়।
এইসব বিপ্লবী গণতন্ত্রীদের লেখা পড়ে জার এর রাশিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছিল তার মনে, যে ঘৃণা মানুষকে বিপ্লবী করে তোলে। ১৬ বছরের বালকটিও পাকাপাকিভাবে বিপ্লবের পাঠ নিল।

১৮৮৭ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ের হলঘরে সভা ডাকলো ছাত্ররা। সভায় দাবি তোলা হলো ছাত্র সংগঠন করার অনুমতি দিতে হবে, বহিস্কৃত ছাত্রদের ফিরিয়ে নিতে হবে , বহিষ্কারের আদেশ যারা দিয়েছে তাদের শাস্তি দিতে হবে। ভ্লাদিমির কে দেখা গেল এই সভার একেবারে সামনের সারিতে । আর সেই রাত্রিতেই আরও ৪০ জন ছাত্রের সঙ্গে ভ্লাদিমিরও গ্রেপ্তার হলো। কাজান থেকে বহিষ্কারের আদেশ হলো তার। ভ্লাদিমির কে অন্তরীণ করা হলো । ভ্লাদিমির এর এই অন্তরীণ জীবন ছিল প্রায় এক বছরের।

এক বছর অন্তরীণ থাকার পরে ১৮৮৮ সালের শেষ দিকে আবার ফিরে এলেন কাজানে। ফিরে এল বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেল না। এমনকি বিদেশে পড়তে যাওয়ার অনুমতি ও সরকার আর দিল না রাষ্ট্র দ্রহিতার অভিযোগে।
ভ্লাদিমির ডুব দিল পড়াশোনার মধ্যে । এবারে বিশেষ করে পড়তে লাগলো মার্ক্স এঙ্গেলস এর বই। ১৮ বছর বয়স তখন। মার্ক্স এঙ্গেলস এর বই যে সব সময় পাওয়া যেত তা নয়। গোটা রাশিয়ায় বেআইনি ছিল মার্কস এঙ্গেলস এর বই। কাজানে সেই সময় কয়েকটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। সেই দলগুলির সাথে যুক্ত হয়ে বিপ্লবী কাজে ধীরে ধীরে পরিকল্পনা করে নিজেকে যুক্ত করতে শুরু করলো ১৮ বছরের ভ্লাদিমির , ভবিষ্যতের লেনিন।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।