কলমের খোঁচা

নেতাজীর রাজনৈতিক আলোছায়া — অর্ণব রায়


চিন্তন নিউজ:২৩শে জানুয়ারি:– আজ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৬-তম জন্মদিবস। তাঁর সমাজতান্ত্রিক চেতনা কতটা সমৃদ্ধ ছিল তা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে- তা অস্বীকার করা যাবে না। সুভাষচন্দ্র ছিলেন একজন প্রকৃতই দেশপ্রেমিক বীর – কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনায় কোন নির্দিষ্ট অভিমুখের বদলে নানা ধ্যানধারণার বিবর্তন ও সংমিশ্রণ দেখা যায় । তাঁর কলেজ জীবনে তিনি বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, অরবিন্দের অনুরাগী ছিলেন। তাঁর এই মানসিক গঠনপর্ব কিছু পাল্টাতে থাকে যখন তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন এবং নানা বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকেন। তাঁর মানসগঠনের দ্বিতীয় পর্বে জাতীয়তাবাদী ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে- কিন্তু তার সঙ্গে সাম্যবাদী ভাবনারও মিশেল ঘটে। আবার, আরো পরে যখন ফ্যাসিবাদের বিপদ ঘনিয়ে আসে ইউরোপে তখন সে সম্পর্কে তাঁর মধ্যে কিছু অস্পষ্টতা দেখা যায়‌। সাম্যবাদের ভিত্তিতে নতুন সমাজ গড়া, জাতিভেদের অচলায়তনকে ধুলিস্যাৎ করা, অর্থের বৈষম্য দূর করা, বর্ণ- ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকে যাতে শিক্ষা ও উন্নতির সমান সুযোগ পায় ইত্যাদি তিনি ১৯২৯ এর ২১শে নভেম্বর মেদিনীপুর যুব সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে বলেছিলেন। ১৯৩০ সালে বিপ্লবী বারীন ঘোষকে লেখা চিঠিতেও সুভাষচন্দ্র সাম্যবাদ ও শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। ১৯৩১ সালে করাচীতে নওজোয়ান ভারত সভায় তিনি ” সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।‌ ঐবছরই মথুরায় নওজোয়ান সভার সম্মেলনে তিনি প্রত্যেক মানুষের কাজের অধিকার, জীবনধারণের পক্ষে যথেষ্ট রোজগারের অধিকারের পক্ষে জোর সওয়াল করেন। ১৯৩৮ এর লণ্ডনের “ডেইলী ওয়ার্কার” পত্রিকায় কমিউনিস্ট নেতা রজনীপাম দত্তের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে ” জাতীয় স্বাধীনতা আমরা চাই, তার বিজয়ের পর আমরা সমাজতন্ত্রের দিকে এগোব।” আরো বিভিন্ন বক্তব্যে তাঁর সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ দেখা যায়। আবার, কমিউনিস্টরা সবকিছুকে শ্রেণী ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মূলত বিচার করে – এ অবস্হান সঠিক নয় বলেও তাঁর ধারণা ছিল। “ইতিহাসের বস্তবাদী ব্যখ্যা” ভারতে ক্ষেত্রে খুব একটা প্রযোজ্য নয় বলেও তাঁর বিভ্রান্ত ধারণা ছিল।

স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে কংগ্রেসের মধ্যে দক্ষিণপন্হী- বামপন্থী লড়াইয়ে সুভাষচন্দ্র কমিউনিস্ট সহ বামপন্থীদের পূর্ণ সমর্থন পান। তিনি শ্রমিক আন্দোলনেও যুক্ত হন- ১৯৩১ সালে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসে কমিউনিস্টদের সমর্থনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন । ১৯৩৪ সাল থেকে নিষিদ্ধ হয়ে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বলিষ্ঠভাবে তাঁকে সমর্থন করে। সেসময় কমিউনিস্ট দের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। হরিপুরায় সভাপতি নির্বাচিত হবার পর ভাষণে তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন – যার কিছু সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ। কিন্তু তার পুরোটা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না। ১৯৩৮ সালে বাংলায় মাসিক গণশক্তি প্রকাশিত হলে সুভাষচন্দ্র উষ্ণ শুভেচ্ছা পাঠান – যা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সেসময় গণশক্তি প্রকাশ করে। তিনি কংগ্রেস সভাপতি হয়ে জহওললাল নেহরুকে প্রধান করে পরিকল্পনা কমিটি গঠন করে খসড়াও অনুমোদন করেন। আগামী ভারতের পরিকল্পনা করার জন্য। ভূমি সংস্কার ,জমিদারী প্রথার বিলোপ, সমবায়প্রথার বিস্তার প্রভৃতি প্রশ্নে তিনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে অনেকটাই সহমত হন। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেস অধিবেশনে প্রধানত কমিউনিস্টদের এবং বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ সমর্থনে গান্ধীজীর প্রতিনিধি পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু কংগ্রেসের দক্ষিণপন্হী অংশ তাঁকে কোণঠাসা করে দেয় এবং তিনি কংগ্রেস সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। যে ফরোওয়ার্ড ব্লক তিনি গঠন করেন , ১৯৪১ সালে তাঁর “কাবুল থিসিসে” দলের লক্ষ্য হিসাবে আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, উৎপাদন- বন্টনে সামাজিক মালিকানা প্রভৃতি ঘোষণা করেন। যদিও ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত তাঁর “দ্য ইণ্ডিয়ান ষ্ট্রাগল” বইতে তিনি ফ্যাসিবাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি প্রকাশও করেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র আবেগ তাঁর দৃষ্টিকে কিছুটা আবিল করে দেয় – যা তাঁর মত নেতার কাছে হয়ত বা প্রত্যাশিত ছিলনা। ১৯৪১ সালে তিনি নাটকীয়ভাবে গোপন দেশত্যাগ করে পেশোয়ার- কাবুল- রোম হয়ে জার্মানীতে পৌঁছান। সেখানে বহুদিন অপেক্ষার পর ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে “শত্রুর শত্রু” ভেবে হিটলারের সঙ্গে অনেকদিন অপেক্ষা করার পর সাহায্যের জন্য দেখা করেন। সেখান থেকে গোপন সাবমেরিনে সাহসী যাত্রায় জাপান অধিকৃত সিঙ্গাপুরে পৌঁছান ১৯৪৩ সালে এবং জাপানের সাহায্য গ্রহণ করতে এগোন – তখন মুসোলিনি সরকারের পতন ঘটেছে, স্তালিনগ্ৰাদে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে অসমসাহসী লড়াইয়ে নাৎসীরা পিছু হটেছে, আগের বছর হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানির সহযোগী অক্ষশক্তির অংশ জাপান, চট্টগ্রামে ও কলকাতায় বোমা ফেলেছে এবং তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আন্দামান- নিকোবর দখল করেছে। জাপ- সাম্রাজ্যবাদের “বৃহৎ এশিয়া মুক্ত ক্ষেত্র” উদ্যোগের তঞ্চকতা বুঝতে তিনি ব্যর্থ হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হিটলারের পরাজয়ের পর জাপান আত্মসমর্পণ করে, সঙ্গে সঙ্গে আই এন এ’ও আত্মসমর্পণ করে। সুভাষচন্দ্র তারপর এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন বলে কথিত। যদিও কমিউনিস্ট পার্টি জাপানের আগ্রাসন নীতির বিরোধিতা করেছিল , কিন্তু আই এন এ-র বন্দীমুক্তির দাবিতে তারা তীব্র জনমত গড়ে তোলে। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জনযুদ্ধের যে ডাক কমিউনিস্ট পার্টি দিয়েছিল তার ফলে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই সাময়িকভাবে কিছুটা ভোঁতা হয়ে যায় – তা অস্বীকার করার উপায় নেই । ফলে কিছু ভুল বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হয়। বহু মানুষের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী আবেগবশত কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কিছু বিভ্রান্তি ও বিরক্তি তৈরী হয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির জয়ের মধ্যে দিয়েই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপনিবেশ থেকে মুক্তি ত্বরান্বিত হবে- এ অবস্হান কমিউনিস্টরা নিয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কমিউনিস্টদের জনযুদ্ধের ডাক তাই ভুল ছিলনা , তা পরবর্তী ইতিহাসও প্রমাণ করেছে ‌।

আবেগের আবরণ সরিয়ে , আমাদেরকে ইতিহাসের ও তার নায়কদেরকে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করতে হবে। তবেই, তার থেকে বর্তমান ও আগামীর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা আমরা নিতে পারব। সুভাষচন্দ্রের মত পরমশ্রদ্ধেয় জাতীয় নায়ককে ইতিহাসসম্মত বিশ্লেষণ করলে তাঁর চিন্তা ভাবনা ও কর্মোদ্যোগের ভূমিকাকে সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বোঝা সহজ হবে । তাহলে, ব্রিটিশদের সহযোগী হিন্দত্ববাদী শক্তির বর্তমান উত্তরাধিকারীরা, নিজেদের স্বাধীনতা- সংগ্ৰামী নায়কের অভাব মেটাতে , আমাদের প্রিয় বীর ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাসম্পন্ন নেতাজীকে নিয়ে যে অনৈতিহাসিক চটকদারী লজ্জাজনক টানাটানি করছে তার উপযুক্ত জবাব আমরা দিতে পারব।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।