বিদেশ

করোনা পরিস্থিতির সফল মোকাবিলা- র হাত ধরে দক্ষিণ কোরিয়ায় বামপন্থীদের নির্বাচনী সাফল্য


মল্লিকা গাঙ্গুলী: চিন্তন নিউজ:১৮ই এপ্রিল:- বিশ্বজুড়ে এক ত্রাসের নাম কোরোনা’-কোভিড ঊনিশ। সমগ্র বিশ্ব এই অতিমারির প্রকোপে দিশাহীন। বর্তমানে প্রথম দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্ব বলে আলাদা করা যাচ্ছে না। তামাম দুনিয়া করোনা মুক্ত হতে স্যানিটাইজেশন, সোস্যাল ডিসট্যান্স, কোয়ারেনটাইন, আইসোলেশন, নীতিতে এক আকাশের নীচে। সর্বত্র সামাজিক বা রাজনৈতিক একত্রীকরন আইন করে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত অথচ এই পরিস্থিতিতেই সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে করোনা অতিমারির মধ্যেই ঘটে গেল দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচন এবং অবিশ্বাস্য ভাবে বিপুল ভোটে জয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট মুন- জে- ইন।

সমস্ত বিশ্বের বিস্ময় বিস্ফারিত জিজ্ঞাসা কিভাবে? কিভাবে? হ্যাঁ দুটি ই কিভাবে!! কিভাবে কোভিড ঊনিশ জয় এবং কিভাবে দীর্ঘ ষোলো বছর পর ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বলে পরিচিত আসলে বামপন্থী দলগুলি এই রকম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হলো? প্রথমেই আসা যাক দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে- সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বেশকিছু কঠোর বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করে গত ১৫ই এপ্রিল বুধবার দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। দেশের সংসদের মোট আসন সংখ্যা ৩০০। ছোট বড় ৩৫ টি দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করলেও মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় বামপন্থী ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে রক্ষণশীল ইউনাইটেড ফিউচার পার্টির। গননা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট মুনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ১৬৩ টি আসনে জয়ী এবং তার সহযোগী সংগঠন প্ল্যাটফর্ম পার্টির আসন সংখ্যা ১৭। কাজেই বামপন্থী মুনের হাতে ১৬৩+১৭=১৮০ টি আসন।

অতএব নিজস্ব সংখ্যা গরিষ্ঠতার জোরেই প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন এর এই ঐতিহাসিক জয়! অথচ গত জানুয়ারি মাসেও চিত্রটা ছিল আলাদা। বাস্তবিক পক্ষে মুন সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছিল! দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি মুষড়ে পড়া, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শান্তি স্থাপনের কোনো সুরাহা করতে না পারা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, সবই সরকারের সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। এমনকি প্রেসিডেন্ট মুন ঘনিষ্ঠদের নানা রকম কেলেঙ্কারির ঘটনা সংবাদ মাধ্যম গুলির মদতে ডেমোক্র্যাটিকদের কোনঠাসা করার প্রচুর সুযোগ করে দিয়েছিল। আর এই সমস্ত নেতিবাচক বিষয় গুলিই বিরোধী প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল।

ঠিক এই সময়েই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রেসিডেন্ট মুন তথা তার দলের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিল! ডেমোক্র্যাটিক দলের কাছে তুরুপের তাস হয়ে হাতে এল কোভিড ঊনিশ অতিমারি! সরকারের কাছে মানুষ কাজ চায় আর করোনা ভাইরাস বামপন্থী ডেমোক্র্যাটিক দের সুযোগ করে দিল মানুষের জন্য কাজ করার। দেশের আপামর জনগনের জন্য পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো বামপন্থী দলগুলি যা তাদের হৃতগৌরব ফিরিয়ে দিল।

দক্ষিণ কোরিয়া সিওল থেকে বিবিসি সংবাদ দাতা লরা বিকার বলেছেন- করোনা মোকাবিলায় মুন সরকার যে যুদ্ধ কালীন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সেই সাফল্যই তাদের সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছে। বিবিসি সূত্রেই জানা যায় “ট্রেসিং অ্যান্ড টেস্টিং” ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার কোভিড ঊনিশ অতিক্রমের বিশেষ কর্মসূচি। দেশে যখন প্রতিদিন প্রায় হাজার জন আক্রান্তে দেশ বিধ্বস্ত সেই সংক্রমণ মুন সরকার অচিরেই তিরিশের নীচে নামতে সক্ষম হয়। রাজধানী সিউল ভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান মিস্টার পার্ক সি ইয়ং নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি করোনা ভাইরাসকে যেভাবে মোকাবিলা করেছে সেটা নজির এবং সেটাই প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তার মূল কারণ।

ভয়ংকর করোনা অতিমারি সাথে নিয়ে দেশের সাধারণ নির্বাচনের পদ্ধতি এবং পরিকল্পনা ও অনুসরণ যোগ্য। ভোট দেওয়ার আগে প্রত্যেক ভোটারের হাত পরিষ্কার করা, মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস পড়া, অন্তত তিন ফুট দূরত্ব রেখে লাইন করা হয়, প্রতিটি ভোটারের তাপমাত্রা মেপে যার দেহের তাপমাত্রা ৩৭.৫ ডিগ্রির বেশি তার হাতেই ব্যালট পেপার তুলে দেওয়া হয়। এমন কি প্রত্যেক ভোটারের ভোট দেওয়ার পর বুথ স্যানিটাইজ করা হয়। দেশের প্রায় ষাট হাজার মানুষ তখন কোয়ারেনটাইনে তাদের জন্য বিশেষ বুথ অথবা পোস্টাল ভোটের বন্দোবস্ত। আক্রান্তদের ও কঠোর নিয়ন্ত্রণে পোস্টাল ব্যালট বা নিদৃষ্ট বুথে ভোট হয়। গন পরিবহন বন্ধ থাকায় ভোটাররা পায়ে হেঁটে বা নিজস্ব বাহনে ভোট কেন্দ্রে আসেন। এক মহিলা ভোটার বিবিসি কে জানিয়েছেন- ভেবেছিলাম কেউ ভোট দিতে আসবে না এবং নির্বাচন স্থগিত করা হবে। কিন্তু এসে দেখি আমার মত অসংখ্য মানুষ লাইনে। এক শহরের মেয়র বলেন, দেশের মানুষ পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করেছে তাই তারা অভিযোগ না করে প্রশংসা করেছে।

আশ্চর্যের বিষয় এই মহামারী পরিস্থিতিতে দেশে ৬০% ভোট পড়েছে। বিগত ১৮ বছরের তুলনায় যা অনেকটাই বেশি। করোনা অন্যান্য দেশের মতোই দক্ষিণ কোরিয়াতেও প্রথম দিকে মারাত্মক রূপ নেয় । কিন্তু ব্যাপক পরীক্ষা- সনাক্তকরন- পৃথকীকরণের মাধ্যমে সরকার খুব দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। মুন সরকারের করোনা ঠেকানোর উদ্যমী প্রচেষ্টা শুধু জনগনের সমর্থন পেয়েছে তাই নয় এমন কি বিরোধী ইউনাইটেড ফিচার পার্টি ও স্বাস্থ্য কর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করে।

তাই বলা যায় করোনা নিরোধ কর্মসূচিই মুন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নির্বাচনী প্রচারের মূখ্য ইস্যু হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ তাদের সমস্ত প্রতিকূলতায় সরকারকে পাশে পেতে চায়। দক্ষিণ কোরিয়ার ডেমোক্র্যাটিক দল এই পোষাকী নামের আড়ালে আসলে বামপন্থী দলগুলি দেশের সংকট কালে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের কথা ভেবে দেশ রক্ষার জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতায় যে লড়াই করেছে মানুষ তার পুরস্কার হিসেবেই বামপন্থী ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে গ্রহণ করেছে। রাজনৈতিক মহলের মতে একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দলই পারে মানুষের সাথে মানুষের পাশে থেকে সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে। দক্ষিণ কোরিয়ার জয় মানুষের জয় বামপন্থার জয়।

একথাও মনে রাখা দরকার দক্ষিণ কোরিয়া খুব কম সময়ে করোনা অতিমারি অতিক্রম এবং মহামারী সঙ্গে নিয়ে গোটা দেশের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে বুঝিয়ে দিয়েছে সদিচ্ছা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকলে সব সম্ভব। কোভিড ঊনিশ অতিমারি থেকে দেশ তথা জাতিকে সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ জীবন ফিরিয়ে দিতে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে মডেল হোক মুন জে ইন এর ডেমোক্র্যাটিক দেশ দক্ষিণ কোরিয়া।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।