বিদেশ

জনতার চোখের জলে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের আজ শেষকৃত্য


মল্লিকা গাঙ্গুলী: চিন্তন নিউজ:১০ই জুন:- সমগ্র বিশ্বে আজ জর্জ ফ্লয়েড এক অনুভূতির নাম। শতাব্দী প্রাচীন শেতাঙ্গ- কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণ বিদ্বেষের নৃশংসতার বলি অতি আধুনিক কর্পোরেট সাম্রাজ্য খোদ আমেরিকার মিনিয়াপোলিস শহরের বুকে। গত ২৫শে মে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে আমেরিকার দোর্দণ্ড প্রতাপ সাদা চামড়ার পুলিশ ডেরেক শেভিন আক্ষরিক অর্থেই গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলে। অবশ্যই ঐ কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিটির কিছু ত্রুটি ছিল। তার কসুর হলো কয়েক দিন আগে সে জেনে বা না জেনে মাত্র কুড়ি ডলার নকল টাকার বিনিময়ে একটি দোকান থেকে কিছু খাবার কেনে। দোকানদার প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ঐ জাল নোট সম্পর্কে পুলিশে জানায়, দুর্ভাগ্য বশত তদন্ত কারি পুলিশ অফিসার ছিলেন চরম বর্ণ হিংস্র নিষ্ঠুর ডেরেক শেভিন ও তার তিন সহযোগী, তিনি জর্জের লঘু পাপে যে গুরু দণ্ড দেন তা নৃশংস শুধু নয় ভয়ঙ্কর জিঘাংসা প্রবণ। ৪৬ বছর বয়স্ক তরতাজা যুবক জর্জকে অফিসার গাড়ির তলায় শুইয়ে তার গলায় হাঁটু দিয়ে চেপে রাখেন আর তার সহকর্মীরা দর্শকের ভূমিকায় পাহারায় থেকে তাকে ঐ কাজে সাহায্য করে। জর্জ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো প্রতিরোধ না করে প্রাণ ভিক্ষা করতে থাকে সে বারবার বলে, “আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না” “আমি মরে যাবো” – এই কাতরতা সত্বেও ফ্লয়েডের শেষ শ্বাস পর্যন্ত অফিসার তার গলায় আরো জোরে হাঁটু চেপে রাখে।

প্রায় ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড পর বিশাল চেহারার যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু নিশ্চিত করে তবেই তিনি উঠে দাঁড়ান। আধুনিক সোস্যাল নেটওয়ার্কের দৌলতে নিমেষেই এই ঘটনা ভাইরাল হয়। আমেরিকা সহ সমগ্র বিশ্ব এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে ওঠে। আমেরিকার সর্বত্র মিছিল, ব্যাপক ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, এমন কি হোয়াইট হাউসের সামনে ও বিক্ষোভ দেখানো হয়। গন বিক্ষোভে প্রাণহানির আশঙ্কায় রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ও মাটির নীচে আধুনিক ভাষায় বাঙ্কারে আশ্রয় নিতে হয়। দেশের ভিতরে এবং বিশ্বের সমস্ত সচেতন মানুষের প্রতিবাদে ভীত ট্রাম্প সরকার শেষ পর্যন্ত হত্যাকারি পুলিশ ডেরেক শেভিন ও তার তিন সহযোগী কে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। শেতাঙ্গ উন্নাসিকতার নির্লজ্জ শিকার সেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের শেষকৃত্য সম্পন্ন হচ্ছে আজ হাউস্টন শহরের প্রেইস চার্চের সমাধি স্থলে। জর্জের প্রায় ৫০০ জন ব্যক্তিগত বন্ধু ও পারিবারিক সদস্য এবং বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত। উপস্থিত আছেন হাউস্টনের মেয়র স্লিভেটর টার্নার, তারকা পল ওয়াল, স্লিম থাগ সহ বহু বিশিষ্ট জন। গতকাল প্রায় ছ’ হাজার মানুষ সারিবদ্ধ ভাবে জর্জ ফ্লয়েডের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শেষকৃত্য শুরুর আগে ফ্লয়েডের ভাই এক শোকবার্তায় জানান- “যদি তাকে বলা হতো বিশ্ব কে একত্রিত করার জন্য তাকে তার জীবন উৎসর্গ করতে হবে- আমি জানি সে তাতে রাজি হতো”। নিজের অজান্তেই জর্জ ফ্লয়েড বিশ্বের সমস্ত বর্ণ বৈষম্যের শিকার কালো মানুষদের একত্রিত করে নতুন করে প্রতিবাদের ঝড় তুলে দিয়ে গেলেন।

একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে প্রথম বিশ্বের সব থেকে উন্নত দেশ আমেরিকার মাটিতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ড নিয়ে আজ সমস্ত বিশ্ব আলোড়িত, কিন্তু এই প্রতিবাদ কি জর্জের কবরের মাটিতেই চাপা পড়ে যাবে?আমেরিকার ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই দেখা যাবে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সেই বিখ্যাত ভাষণ- “আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম”- যে ভাষণে তিনি বলেছিলেন “জন্ম সূত্রে আমরা সকলে মানুষ” অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আমরা “সকলে সমান”। লুথার জুনিয়রের নেতৃত্বে তখন শুরু হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই । অবশেষে ১৯৬৪ সালে আমেরিকার শেতাঙ্গ সরকার বেশ কিছু ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ দের অধিকার দেয় এবং ১৯৬৫ সালে আমেরিকার কালো মানুষের ভোটাধিকার দিতে ও বাধ্য হয়। জনমতের চাপে কৃষ্ণাঙ্গ দের অধিকার দিতে বাধ্য হলেও শেতাঙ্গদের জাতি সত্ত্বায় যে বর্ণ হিংসা যে উচ্চ নীচ বিভেদ তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বদ্ধমূল আর তার ই নির্মম প্রকাশ, বর্বরতার চরমতম নিদর্শন, জর্জ ফ্লয়েড হত্যা।

সাম্প্রতিক বিশ্বের সবথেকে বড় সংকট করোনা অতিমারি, যার মারাত্মক সংক্রমণের শিকার আমেরিকা। বিশ্বের প্রথম স্থানে থাকা আমারিকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত, সেখানে অব্যাহত মৃত্যু মিছিল, অথচ রাষ্ট্রের কল্যাণকর ভূমিকা অদৃশ্য হয়ে অনাবৃত পুলিশি দমননীতি। অপর দিকে সেখানে সাদা কালো নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ করোনার মৃত্যুভয়কে অস্বীকার করে “জাস্টিস ফর জর্জ ফ্লয়েড” এর দাবিতে পথে নেমেছে। জর্জকে কেন্দ্র করে এই প্রতিবাদ কি নিছক একজন কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েডের জন্য? না! আসলে এই বিক্ষোভ আমেরিকার ফ্যাসিবাদী কুশাসনের বিরুদ্ধে। সমগ্র বিশ্বে আজ স্বজন হারানোর জ্বালা যন্ত্রণা, অপমান, বঞ্চনা আর রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের অভ্যন্তরে যৌথ শক্তিতে সাম্য প্রতিষ্ঠার বীজ বপন হয়েছে। সমগ্র বিশ্বের শাসক শ্রেণীর সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। শুধু প্রচার মাধ্যমে সাম্য, মৈত্রী, গনতন্ত্রের ধ্বজা ওড়ানোর দিন শেষ।আমেরিকা শুধু নয় তামাম বিশ্ব আর কোনো জর্জ ফ্লয়েড হত্যা মেনে নেবে না, আর কোনো ডেভিড শেভিন কে ক্ষমা করবে না। আধুনিক বিশ্বে এখনো জাতি- ধর্ম- বর্ণ- চামড়া আর অর্থের কারনে মানুষে মানুষে যে শ্রেণী বিভাজন জর্জের ঘটনার প্রেক্ষিতেই তার অবসান হওয়া উচিত। বিশিষ্ট ফরাসি ফুটবল তারকা পল পোগবা জর্জ ফ্লয়েডের হত্যায় দারুন মর্মাহত হয়েই আওয়াজ তুলেছেন- “আজই শেষ হোক বর্ণবাদ” তার ভাষায় “বর্ণবাদ অজ্ঞতা, ভালোবাসায় হলো বুদ্ধিমত্তা” – ফুটবল তারকার আওয়াজে গলা মিলিয়ে সমস্ত মনন শীল মানুষের ও দাবি, চরম উলঙ্গ, বিভৎস, বর্ণ বিদ্বেষের শিকার কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের শেষকৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী ব্যাপী সমস্ত প্রকার বিভেদ বৈষম্যের সমাধি হোক।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।