রাজনৈতিক রাজ্য

প্রতিশ্রুতিই সার প্রাপ্তির ভাড়ার প্রায় শূন্য, কেন্দ্র-রাজ্যের ভাগাভাগির তরজায় জেরবার জলপাইগুড়ি কেন্দ্রের মানুষ চায় লড়াকু তরুণ বাম প্রার্থীকে


দীপশুভ্র সান্যাল: চিন্তন নিউজ:০৩/০৪/২০২৪:-
জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে রয়েছে কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ বিধানসভা। কালিংপং জেলার প্রান্তসীমা মালবাজার পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে সুদূর বাংলাদেশ সীমান্তের সাতকুরা, মানিকগঞ্জ কোচবিহার জেলার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মেখলিগঞ্জ মহকুমা, অপরদিকে সেবক পেরিয়ে শিলিগুড়ি সমতলে ঢোকার মুখে শুকনার বনাঞ্চল থেকে শুরু করে শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের অধীন ১৪ টি ওয়ার্ড, শিলিগুড়ি শহর সংলগ্ন ডাবগ্রাম১, ডাবগ্রাম ২, ফুলবাড়ি ১, ফুলবাড়ী ২ চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলার প্রান্তসীমা ধূপগুড়ি মহকুমা পর্যন্ত বিস্তৃত জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্র। বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা বিধানসভা অঞ্চল আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত।

জলপাইগুড়ি লোকসভায় কেন্দ্রের এই বিস্তীর্ণ এলাকায় রয়েছে বনভূমি চা বাগান পাহাড় সংলগ্ন এলাকা বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল বনবস্তি কৃষি এলাকা বিস্তীর্ণ সীমান্তবর্তী এলাকা। পৃথিবী বিখ্যাত গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক থেকে শুরু করে, তিন বিঘা করিডোর ফুলবাড়ি করিডোর, ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের সম্প্রতি চালু হওয়া মিতালি এক্সপ্রেস এর ইমিগ্রেশন সেন্টার হলদিবাড়ি স্টেশন, এন জি পি স্টেশন এই লোকসভা এলাকাধিন। লোকসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষি শ্রমিকরা কাজের অভাবে দক্ষিণ ভারতে কাজের খোঁজে যান, ডুয়ার্স এলাকা, চা বাগান বনবস্তির মানুষরা এলাকায় কাজের অভাবে প্রতিবেশী রাজ্য সিকিম প্রতিবেশীদেশ নেপাল, ভুটানে কাজ করতে যান। বাম জমানার দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল কলকাতা হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ সম্প্রতি জলপাইগুড়িতে অস্থায়ীভাবে শুরু হয়েছে বামফ্রন্টের জেলা পরিষদের তৈরি জলপাইগুড়ি স্টেশন সংলগ্ন ডাক বাংলোয়। এক সময় জাতীয় কংগ্রেস এই লোকসভা আসনে জয়যুক্ত হলেও সত্তরের দশক থেকে এই লোকসভা কেন্দ্রে জয়যুক্ত হয়ে আসছিল বামপন্থীরা স্বনামধন্য জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব পরবর্তী সময়ে বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়া খগেন দাশগুপ্ত, রাজ্যের উত্তর অংশের চা শ্রমিক আন্দোলন ও সিপিআইএম পার্টি গড়ে তোলা ও বিস্তারের অন্যতম নেতৃত্ব সুবোধ সেন,মানিক সান্যাল ছিলেন এই লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ। পরবর্তীতে জিতেন দাস, মিনতি সেন, বামফ্রন্ট জমানার শেষের দিকে ২০০৯ এর রাজ্যের অধিকাংশ আসনে তৃণমূল জয়ী হলেও মহেন্দ্র কুমার রায় এই লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হন।

২০১১ এর পর থেকে ২০১৩ পর্যন্তও জলপাইগুড়ি র লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত ও ২০১৩র পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদে ও অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত পঞ্চায়েত সমিতিতে জয়ী হয় বামপন্থীরা। পরবর্তীতে চিটফান্ডের টাকায় বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েত সদস্যদের ক্রয় করে, বিভিন্ন পঞ্চায়েত সমিতি টাকার জোরে নয়তো গায়ের জোরে দখল করতে শুরু করে তৃণমূল। ২০১৪ সালে এই কেন্দ্রে মহেন্দ্র কুমার রায়কে হারিয়ে জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয় চন্দ্র বর্মন, ২০১৯ সালে বিজয় চন্দ্র বর্মনের ঘনিষ্ঠ উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের ডাক্তার জয়ন্ত কুমার রায় বিজেপির সংসদ হিসাবে এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে লোকসভায় এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বলেছিল সবজি মান্ডি কৃষি মান্ডি কৃষক বাজার টমেটো থেকে সস বানানোর প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, বিস্তীর্ণ এলাকায় থাকা চা শিল্পের উন্নয়নকল্পে জলপাইগুড়িতে টি অকশন সেন্টার পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু করা, জলপাইগুড়ি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের উন্নতি সাধন করে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম গড়ে তুলে জলপাইগুড়িতে খেলাধুলা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করা, জলপাইগুড়ির বিভিন্ন মহকুমায় সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল গড়ে তুলে চিকিৎসা ব্যবস্থা আমূল উন্নতি সাধন সহ অসংখ্য প্রতিশ্রুতি।

বাস্তবক্ষেত্রে জলপাইগুড়িতে দুটি মহকুমায় সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল গড়ে উঠলো অথচ সেখানে ডাক্তার বাবু, নার্সের অভাবে চালু হলো প্রাথমিক চিকিৎসা করে দুদিন পরে রেফার করার ব্যবস্থা। সম্প্রতি জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হিসাবে তাতেও ফেরেনি জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল, দুবার টি অকশন সেন্টার জোড়াতালি দিয়ে চালু হলেও স্থায়ীভাবে চালু করা সম্ভব হলো না, বাম আমলে জমি অধিগ্রহণ থেকে আরম্ভ করে স্টেডিয়াম তৈরি সবটাই হয়েছিল জলপাইগুড়ি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে একটি স্টেডিয়াম নতুন করে তৈরি আর কিছু অন্যান্য পরিকাঠামগত উন্নতি করা হলেও জাতীয় স্তরের এমনকি রাজ্য স্তরেরও কোন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা সম্ভব হয় নি তৃণমূল কংগ্রেসের শাসনকালে।

উপরন্তু ক্রীড়া জগতে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সরকারি দাদাগিরির কারণে স্থানীয় ক্লাব ও ক্রীড়া সংস্থা এক প্রকার বর্জন করে জলপাইগুড়ি স্পোর্টস কমপ্লেক্সকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জননেতা জ্যোতি বসুর হাতে শিলান্যাস হওয়া ও তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জলপাইগুড়িতে গড়ে ওঠা স্পোর্টস কমপ্লেক্স রাজ্য সরকার দিয়ে দিল স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (সাই) এর হাতে। শাসক দলের সংসদের বিরুদ্ধে চরম স্বজন পোষণ ও কাজ হওয়ার আগেই কন্ট্রাক্টরকে ডেকে কাটমানির
টাকা বুঝে নেওয়া অভিযোগ তুললেন দলের একাংশ।
২০২৮ পঞ্চায়েত ভোট থেকে জবরদখল কমতে থাকলেও ২০১৯ সালের তৃণমূল বিরোধী সমস্ত ভোটারদের এক বড় অংশ ভোট দিলেন বিজেপির প্রতীকে। বিরাট মার্জিনে তৃণমূলকে হারালো বিজেপি, অভিযোগ সেই নির্বাচনের পর কয়দিনই লোকসভা কেন্দ্রের মানুষ দেখেছিল সাংসদ জয়ন্ত কুমার রায়কে তারপর কোভিড অতিমারি, বিধানসভা নির্বাচন, তারপর কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ সবেতেই মানুষ হতাশ সাংসদের পারফরমেন্সে।

অন্যদিকে বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা শূন্য হাতে ফিরলেও লোকসভায় একটি আসনে জয়যুক্ত না হয়েও কোভিড অতিমারির সময় বামপন্থী ছাত্র যুব রেড ভলেন্টিয়ার্স সহ বামপন্থীদের ভূমিকা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে বিভিন্ন বিধানসভার উপনির্বাচন, রাজ্য জুড়ে পৌরসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের লড়াই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

এই কেন্দ্রে বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআইএম প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন ২০০৮ সালের জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক শিক্ষিত তরুণ যুব আন্দোলনের নেতৃত্ব রাজগঞ্জের শাহুডাঙ্গী হাই স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক দেবরাজ বর্মন। মাউতঅর্গান প্লেয়ার দেবরাজ বর্মন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চা বাগান বনবস্তি ছোট বড় হাত বাজার সহ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা ক্ষেত্রেই প্রচারে বেরিয়ে চা বাগান, কৃষি বলয় জলপাইগুড়ির খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রাম সংসদে তুলে ধরার বার্তা দিচ্ছেন। যুব আন্দোলন সহ বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি বাংলাদেশ হয়ে কলকাতা গামী ট্রেন চালু সম্প্রতি এনজিপি স্টেশন থেকে ঢাকাগামী ট্রেন চালু হলেও,
এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মন্ডল ঘাট হলদিবাড়ি ধূপগুড়ি ময়নাগুড়ির, আলু টমেটো, কাঁচালঙ্কা সহ তিস্তা জলঢাকার চরের টাটকা সবজির বাজার রয়েছে সমগ্র পশ্চিমবাংলা জুড়ে, বিস্তীর্ণ কৃষি এলাকায় দাবি রয়েছে বহুমুখী হিমঘর গড়ে তোলার। কলকাতার বাজারে কম সময়ে এই এলাকার শাক সবজি কম সময়ে পৌঁছতে জেলার পর্যটন শিল্প উন্নয়নকল্পে বাংলাদেশ থেকে আসা পর্যটকদের কম সময়ে কলকাতা নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছতে বাংলাদেশ হয়ে কলকাতা গামী ট্রেনের দাবি দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে ময়নাগুড়িতে জনসভা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন বন্ধ চা বাগান অধিগ্রহণ করা হবে কিন্তু হয়নি। উল্টে রাজ্যের শাসক দল এর তোলাবাজি দাদাগিরিতে ধুঁকছে উত্তর বাংলার চা শিল্প, চা শ্রমিকদের যুক্ত মঞ্চ জয়েন্ট ফোরামের দীর্ঘ আন্দোলনের পরও সরকার চালু করেনি ন্যূনতম মজুরি। বাম জমানায় গড়ে ওঠা রানীনগর , রাজগঞ্জ শিল্প তালুককে একটিও নতুন শিল্প গড়ে ওঠেনি শাসকদলের তোলাবাজি দাদাগিরিতে নাভিশ্বাস শিল্পপতিদের

এই শিল্প-তালুকে দাঁড়িয়েই তৃণমূলের শ্রমিক নেত্রী দোলা সেন ঘোষণা করেছিলেন চার আনা রেখে আট আনা কালীঘাটে পাঠানোর তত্ত্ব যা এখনো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের পরিবেশিত হয়। পাহাড় থেকে নেমে আসা বিভিন্ন নদীতে বুলডোজার নামিয়ে চলছে বোল্ডার তোলা, বালি তোলার কাজ।

গত লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী সময় এই লোকসভা কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে গড়ে ওঠা ন্যাশনাল হাইওয়ে ওভারব্রিজ সহ কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অবৈধ বালি মাটি বোল্ডার সাপ্লাই দিয়েছে তৃণমূলের সাপ্লাইয়ারা। প্রচারে নেমে বিভিন্ন এলাকায় প্রার্থী শুনছেন তৃণমূল বিজেপির ভাগ করে খাওয়ার গল্প। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতি ছিল জলপাইগুড়ির সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নকল্পে ট্যুরিজম প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে হয়নি উল্টে রাজ্যের শাসকদলের মদতে চলছে অবৈধ ভাবে জঙ্গল সাফাই, কাঠ পাচার। জঙ্গলে খাবার না থাকায় প্রায়শই বন্যপ্রাণীরা খাবারের খোঁজে বেরিয়ে আসছে গ্রাম্য এলাকা সহ ডুয়ার্সের বিভিন্ন শহর শহর সংলগ্ন জনবসতিতে। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ভেতরে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস সে কিছু বিষয়ে পড়ানো চালু হলেও ছাত্রদের দীর্ঘদিনের দাবি জেলায় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠেনি।

প্রচারে বেরিয়ে বামফ্রন্টের সিপিআই(এম)প্রার্থী দেবরাজ বর্মন চা বাগান, কৃষি এলাকার মানুষের দাবির কথা ডুয়ার্সের পর্যটনের উন্নতির দাবি, জেলায় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কলকাতা ঢাকা প্রেম অবিলম্বে চালু করার দাবি সহ এলাকার মানুষের দাবি সংসদে তুলে ধরতে বামফ্রন্ট কে কাঁদতে হাতুড়ি তারা প্রতীকে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। শাসকবিরোধী তরজায় বিরক্ত লোকসভা কেন্দ্রের মানুষ তাই এবারের নির্বাচনে ভরসা রাখতে চাইছেন বামপন্থীদের প্রতি বামপন্থী তরুণ যুবক দেবরাজ কে জয়যুক্ত করতে গোটা লোকসভা কেন্দ্রে চোখে পড়ছে কম বয়সী তরুণ তরুণী থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন বা আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা প্রবীনদের জান কবুল লড়াইয়ের মেজাজ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।