রাজনৈতিক

সতর্কবার্তা কে দিচ্ছেন, কাদের দিচ্ছেন সেটাও একটা ব্যাপার — সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:৪ঠা জুলাই:– “দুর্নীতি থেকে দলের নেতা-কর্মীরা যাতে দূরে থাকেন, সে ব্যাপারে বারবার সতর্ক করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু আমপান ক্ষতিপূরণের তালিকা নিয়ে ভুরি ভুরি অভিযোগ বুঝিয়ে দিয়েছে, সেই সতর্কবার্তা অনেক নেতার কানেই পৌঁছায়নি।” (আনন্দবাজর পত্রিকা ২৯ জুন’২০)। ‘অনেক নেতার’ বদলে কোনো নেতার কানেই পৌঁছায়নি কথাটা এইভাবে লিখলেই বোধকরি সঠিক হত, সত্যি হতো। আসলে বাজারি মিডিয়াও পড়েছে ফাঁপড়ে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে নীতিহীন, আদর্শহীন, তঞ্চকতা আর ক্ষমতালিপ্সায় চক্ষুলজ্জার বালাইহীন, বাংলাকে নৈরাজ্যের নেইরাজ্যে রূপান্তরিত করে লুটের মৃগয়াক্ষেত্র বানানোয় ক্লান্তিহীন এক হিংসাশ্রয়ী ঔদ্ধত্যের গর্ভজাত এই ‘তৃণমূলী’ অশ্লীলতা, নষ্টামি এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, এমনকি বাজারি মিডিয়াও তা আর চাপতেও পারছে না আবার স্বাভাবিক বন্ধুকে বাঁচানোর দায়িত্বও ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। তাই খাড়া করতে হচ্ছে, “দুর্নীতির অভিযোগ সব সরকারের বিরুদ্ধেই থাকে, তখনও ছিল এখনো আছে” বা “নেত্রী স্বচ্ছ, চেষ্টা করছেন খুব, দলের কেউ কেউ একটু আধটু করে খাচ্ছে, কথা শুনছে না ইত্যাদি প্রভৃতি যত্তসব বস্তাপচা ছেঁদো তত্ত্ব। কিন্তু আসল প্রশ্নচিহ্ন তো ঠিক ওখানেই ! সতর্কবার্তা দিচ্ছেন কে ? স্বয়ং যাঁর মুখনিঃসৃত বচন, বিভঙ্গ আর ‘এলো মেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই’ কান্ডকারখানাই রাজ্য জুড়ে প্রকৃত পক্ষে তৃণমূলী প্রেত নৃত্যের উৎসস্থল, তিনি ? যিনি স্বয়ং প্রথম দিন থেকে ‘ছোটো ঘটনা’, ‘সাজান ঘটনা’, ‘তুচ্ছ ঘটনা’, ‘স্মল ম্যাটার’ ,‘ পেটি ম্যাটার’ ইত্যাদি শব্দবন্ধে দলীয় ভৈরববাহিনীর যাবতীয় দুষ্কর্মকে সচেতনভাবে আড়াল করেছেন,সর্বনাশা অপকর্মকে দ্বিধাহীনভাবে প্রশ্রয় দিয়েছেন, বেলেল্লাপনাকে বহু যত্নে স্নেহান্বিত করেছেন, মদত জুগিয়েছেন, লঘু করেছেন, তিনি ? মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন থেকে আদালত, কর্তব্যরত পুলিশ কর্মচারি থেকে সাংবাদিক, অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরী,তানিয়া ভরদ্বাজ,টুম্পা কয়াল,মৌসুমি কয়াল- সাধারণ নাগরিক থেকে বিদ্বজন ধমকানি আর চমকানিতে যিনি স্বয়ংসিদ্ধা তিনি ? সারদায় সর্বস্বান্ত প্রতারিত আমানতকারীরা যখন প্রথমেই তাদের বিক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে তপসিয়ার তৃণমূল ভবন আর কালিঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি টাকা ফেরতের দরবার করতে গিয়েছিলেন তখন মুখ্যমন্ত্রী তাদের কী বলেছিলেন ? “ যা গেছে তা গেছে। ধৈর্য্য ধরুন, শান্ত থাকুন এখন এমন একটা সরকার এসেছে যারা মানুষের কথা ভাবে”(আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ এপ্রিল’১৩)। কি ভেবেছেন তিনি ও তার সরকার ? কোনো কিনারা হয়েছে সারদা, রোজভ্যালি, ত্রিনেত্র,নারদ- একটা কেলেঙ্কারিরও ? একশ দু’জন আত্মহত্যা করেছেন কিন্তু কেউ টাকা ফেরৎ পেয়েছেন ? ‘তুমি আমার লোভের খাতায় লাভের অঙ্ক বাড়িয়ে যাও, আমি তোমার লোক ঠকানোর অবাধ ও উর্বর বিচরণভূমি বাড়িয়ে যাবো’ দিদি মোদীর এই রসায়নে সারদা তদন্তে মাঝেমাঝে কয়েকটা কান টেনে মূল মাথাকে রক্ষা করে তদন্তর বারোটা বাজানো হয়নি ? বরং ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর বিধাননগর কমিশনারেটের সামনে সারদা মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে আর মুখ্যমন্ত্রীকেও জেরা করার দাবী জানাতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সিপিএম বিরোধীতায় এক সময় মাননীয়ার বিশ্বস্ত সহচর অশীতিপর সুনন্দ সান্যাল ( বলেছিলেন,“ আমার ৮১ বজরের জীবনে এই প্রথম থানায় গ্রপ্তার হয়ে আসত হলো, ধাক্কা খেতে হলো পুলিশের। আমরা চেয়েছি সিবিআই তদন্ত, মমতাকেও জেরা করতে হবে। শুধু এই দাবী করার জন্যে এই পরিণাম কল্পনাও করতে পারিনি) আর তখনই এই অভিযোগ প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল তৃণমূলের বড়, মাঝারি, ছোটো খেলোয়াড় নয় কালিঘাটের ভিআইপি বাড়িই আসলে সবকটি চিটফান্ডের লুটতরাজের গর্ভগৃহ আর তপসিয়ার তৃণমূল ভবন তার সযত্ন লালন-পালন ও নিরাপদ পরিচর্যা কেন্দ্র। সেই তিনি দিচ্ছেন সতর্কবার্তা ! যিনি গোপনে নয় নয় বছরের কৃতকর্মের মধ্যদিয়েই প্রকাশ করে দিয়েছেন,“ বসে নয়, করে খাও” এই হচ্ছে তার কর্মচঞ্চল ‘মা-মাটি-মানুষের’ সরকারের অদ্বিতীয় অভিমুখ। যেমন ধরা যাক, তোলাবাজিকে শিল্পে রূপান্তরিত করে খাও, ডক কে ডকে তুলে খাও, কলার তুলে নয় সিন্ডিকেট করে খাও, দরকারে দলীয় কর্মীকেও খালাস করে জলা বুজিয়ে খাও, পৌরসভা-পঞ্চায়েতের শরীর থেকে রক্ত চুষে খাও, রেশনের চাল দেদার চুরি করে খাও, ত্রিফলা থেকে খাও, টেট থেকে খাও, শুধু রাজ্যের যারা সাধারণ বেকার যুবক-যুবতী তারা তেলেভাজার দোকান করে খাও। সেই তিনি দিচ্ছেন সতর্কবার্তা! আর তৃনমূল সুপ্রিমো কাদেরকেই বা সতর্ক করছেন ? শুরু থেকেই চুরি, জোচ্চুরি,লুট, খুন, ধর্ষন, শ্লীলতাহানী, জরিমানা আদায়, সিন্ডিকেট, তোলাবাজি, জমি থেকে কৃষক- বর্গাদার- পাট্টাদার উচ্ছেদ, ভাঙচূড়, অগ্নিসংযোগ, লাঠির জোরে কলেজ ছাত্র সংসদ, পরিচালন সমিতি, সমবায় সমিতি দখল এই ক্লীবত্বকে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশ্রয়ে যে বীরপুঙ্গবরা দল প্রদত্ত পবিত্র দায়িত্ব হিসাবে ভেবে এসেছে ও পালন করে এসেছে, যাদের সৌজন্যে রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সভ্যতার পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাকর, ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ক্ষতিকর অসংখ্য উদাহরণ, লুঠ এখন যাদের কাছে কেবলমাত্র অবশ্য পালনীয় রাজনৈতিক দায় নয়, বেঁচে থাকার অপরিহার্য অক্সিজেনও বটে তাদের ? যাক,তবু এই আলোচনায় আপাতত বেশী গভীরে প্রবেশ না করে শুধু এইটুকু কেবল বলা যেতেই পারে পরিস্তিতি বর্তমানে ভয়ঙ্কর, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সরকার নেই, প্রশাসন নেই। এযেন আক্ষরিক অর্থেই জঙ্গলের রাজত্ব, মস্তানরাজ। পার্থক্য শুধু একটাই মুখ বুজে সব সোয়ে যাওয়ার দিন শেষ। সারা রাজ্যে এখন প্রতাপাদিত্য দাদা দের কান ধরে ওঠবোস, ‘আমি চুরি করব না, আর করব না’- মুচলেকা আর ঠেলায় পড়ে লুটের টাকা ফেরতের হিরিক – সৌজন্যে রাজ্যের শাসক দল প্রবল পরাক্রমশালী ‘সর্বভারতীয়’(!!) তৃণমূল কংগ্রেস। যারা এই সেদিন হাতে মাথা কাটছিল, এই রাজ্যের প্রতিবাদী মানুষের (২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি ব্লকের পঞ্চায়েত আধিকারিক হজরত ওমরের কান কেটে শাস্তি দিয়েছিল তৃণমূলী জল্লাদরা ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার অথরাধে) কান কেটে শাস্তি দিয়েছিল, প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা (বীরভূমের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা ধীরেন লেট) কে কান ধরে ওঠবস করিয়েছিল আজ তারাই বঞ্চিত, অত্যাচারিত বিক্ষুব্ধ মানুষের বাঁধভাঙা ক্রোধের সামনে কান ধরে উঠবোস করছে। আর লুটের টাকা ফেরৎ দিচ্ছে। তৃণমলের ব্লক সভাপতি, প্রধান, সদস্যদের বাড়ি ঘিরে রাখছেন ক্ষুব্ধ মানুষ, এমন কি বাড়ির থেকে টেনে বার করে পঞ্চায়েত অফিসে নিয়ে এসেও লুটের টাকা আদায় করছেন। আসলে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, গণতন্ত্রদলনকারী একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচার, নৈরাজ্য, লুম্পেন সংস্কৃতি, হিংসা,বিদ্বেষ, মস্তানি, সীমাহীন দুর্নীতি, তোলাবাজি আর লাগামহীন মিথ্যাচার এতগুলো ধ্বংসাত্মক উপাদান যদি একই সঙ্গে, একই গতিতে একটি দলের মধ্যে দীর্ঘদিন ক্রীয়াশীল থাকে তাহলে তার ভয়ঙ্কর পরিণতি ও পরিণাম এইরকমই হয়। সাম্প্রতিক করোনা জনিত লকডাউন আর সুপারসাইক্লোন আমফানে বিধ্বস্ত মানুষ আবার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলেন বামপন্থীদের। বামপন্থী কর্মীরাও বিশেষকরে বামপন্থী যুব কর্মীরাও তাদের গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হলেন মানুষের পাশে থাকা, কাছে থাকা বামপন্থীদের ক্ষমতার মগডালে ওঠার মই নয়, রাজনৈতিক মতাদর্শগত দায়। বিকল্প বামপন্থাই।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।