দেশ

ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী নামে বিভাজন।


মাধবী ঘোষ: চিন্তন নিউজ:১১ই ডিসেম্বর:–৬ই ডিসেম্বর ছিল ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার ২৭ তম বার্ষিকী। এর ঠিক দুই দিন পরই দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা দেশটির হাজার ৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংশোধনী অনুমোদন করে। যে সংশোধনীর মাধ্যমে মুসলমানদের বাদ দিয়ে অন্য প্রধান ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ করা হবে।
মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর ৯ই ডিসেম্বর প্রস্তাবটি সংশোধনীগুলো দিলা কারে দেশটির পার্লামেন্টে উত্থাপিত হয়। ধারণা মতই ৩১১ বনাম আছি ভোটের বিশাল ব্যবধানে লোকসভায় অনায়াসেই পাশ হয়ে যায় তা । বিজেপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে সেখানে রাজ্যসভায় যদিও দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই কিন্তু সেখানেও বিরোধী কিছু দল বিলের বিরুদ্ধে ওয়াক আউট করে কার্যত বিলটি পাশে বিজেপিকে পরোক্ষে সাহায্য করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে । বিজেপি নেতৃত্ব এসব হিসাব কষেই গুরুত্বপূর্ণ এই আইন পাল্টানোর কাজে হাত দিয়েছে নতুন করে।

এখন বিলটি যাবে রাজ্যসভায়। সেখানে যদিও বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই কিন্তু বিরোধী কিছু দল বিলের বিরুদ্ধে ওয়াকআউট করে কার্যত বিলটি চূড়ান্তভাবে পাশে বিজেপিকে পরোক্ষে সাহায্য করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মোদী অমিত শাহ জুটি এসব হিসাব করেই গুরুত্বপূর্ণ এই আইন পাল্টানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন এবং তারা এখনো কোনো বাধার মুখে পড়ে নি।

এ মুহূর্তে যে সব হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিকত্বহীন অবস্থায় ভারতে বসবাস করছেন, তারাই মূলত সংশোধিত তারাই মূলত সংশোধিত নতুন আইনের প্রধান সুবিধাভোগী হবেন। বিশেষত যেসব হিন্দু দাবি করেছেন, তারা পাকিস্তান আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশ ছেড়েছেন। তাদের ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন আইন সাহায্য করবে বলে বিজেপি প্রচার করছে। অর্থাৎ এই হিন্দুরা ভারতে আর অবৈধ অভিবাসী বিবেচিত হবেন না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলে সে সব তুলে নেয়া হবে। একইভাবে ভারতে আসা শিখ জৈন পারসিক বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা সুবিধা পাবেন। তবে যারা ২০১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছেন, তারাই কেবল এরকম সুবিধা দাবি করতে পারবেন । আইনে অবশ্য ধর্মীয় নিপিরণ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। ধর্মীয় নিপীড়নের ঘটনা কিভাবে প্রমাণিত হবে সে সম্পর্কেও আইনে কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। আইনে অমুসলমানদের ও নাগরিকত্ব পাওয়ার কিছু শর্ত শিথিল করা হয়েছে। আগে নাগরিকত্ব পেতে বসবাসের সর্বশেষ ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকার শর্ত ছিল। এখন সেটা পাঁচ বছর করা হচ্ছে।

বিজেপি সরকার ২০১৬ সালে ও নাগরিকত্ব আইন এর এরূপ একটা সংশোধনী এনেছিল। তখন রাজ্য সভায় অনুমোদন করাতে পারেনি তারা সেই সংশোধনী। ওই সংশোধন প্রস্তাবের সঙ্গে এবারের আইনের কিছু পার্থক্য আছে। আগেই সংশোধনীতে কোন ‘কাট অফ ডেট'” ছিল না। এবার স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে ও মুসলমান যারা ভারতে ঢুকে ছেন তাদের ক্ষেত্রে এই আইনের ব্যবহার হবে। আবার পূর্বতন সংশোধনীতে পুরো দেশে নতুন বিধানের কার্যকারিতার কথা বলা হলেও নতুন আইনে উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু কিছু এলাকাকে আইনের কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন আসামের অসমীয়া প্রধান সাতটি জেলায় নতুন আইনের কার্যকারিতা থাকবে না বলা হচ্ছে।

এই আইনের মধ্য দিয়ে বিজেপি দেখতে চাই ভারত হিন্দুদের জন্য একটা স্থায়ী নিরাপদ আশ্রয়। যেভাবে ইসরাইল ইহুদিদের জন্য। এই আইন ভারতে নাগরিকত্ব কে স্পষ্ট সাম্প্রদায়িক ভিত্তি দিচ্ছে। নাগরিকতার ফটোগুলো যে কোন রাষ্ট্রের একটা মৌলিক দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই বছরের ১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস ভারত খোলামেলা ভাবে ঘোষনা দিয়েই তার আস্তে ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য থেকে সরে গেল। কিন্তু সেটা ভারতের সংবিধানের কিছু কিছু ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেই মত দিচ্ছে বিজেপি বিরোধীরা।

বিজেপি এমনভাবে বিলটিকে প্রচারে এনেছে যাতে মনে হয় সেই বিলের বিরোধিতাকারী মাত্রই হিন্দুদের বিরুদ্ধে। এই বিল যে ভারতের সংবিধান ও এতদিনকার রাষ্ট্রীয় চরিত্রের ও বিরুদ্ধে যাচ্ছে সেটা তাই বিরোধী দলগুলো উৎকণ্ঠা তুলে ধরতে পারছে না এবং ভোটের ভয়ে তুলে ধরতে চাইছে ও না তবে কংগ্রেস লোকসভায় এই আইনের বিরোধিতা করছে। রাজ্যসভায় ও তারা এটাকে আটকাতে চাইবে।

নতুন আইনগত সংশোধনী সবচেয়ে জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে আসামে। সেখানে যেসব অমুসলমান ইতিমধ্যে এনআরসি তে নাগরিকত্ব হারিয়েছিলেন তারা এই আইনে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ আগে তারা এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হতে আবেদন করেছিলেন ভারতীয় নাগরিক দাবি করে। এখন নতুন আইনে সুবিধা পেতে হলে আবেদন করতে হবে বাংলাদেশে কিংবা পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে। যা হবে স্পষ্টতই প্রতারণামূলক ও স্ববিরোধীতা মুলক। যদিও আসাম জুড়ে বিজেপি এনআরসি তে বাদ পড়া হিন্দুদের নাগরিকত্বের লোভে ফেলেছে নতুন আইনে।

কৌতূহলোদ্দীপক একটা দিক হলো, আলোচ্য আইন ভারত রাষ্ট্রের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এলে ও দেশটির প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যম নাগরিকত্ব আইন সংশোধনকে প্রত্যাশিত গুরুত্ব দেয়নি ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।