রত্না দাস: চিন্তন নিউজ:১৫ই জুলাই:-উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের প্রারম্ভিক পর্বে যে ক’জন মনীষা জ্ঞানের আলোকবর্তিকায় তমসাচ্ছন্ন সমাজকে উদ্ভাসিত করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম অক্ষয় কুমার দত্ত। ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পিতামহ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃত, জ্যোর্তিবিদ, বহু ভাষাবিদ ,সম্পাদক , লেখক ও সমাজ সংস্কারক অক্ষয় কুমারের অনেক কীর্তি সাধারণের কাছে অজানা রয়ে গেছে।
১৮২০সালের ১৫ ই জুলাই বর্ধমানের চুপীগ্রামে জন্ম অক্ষয় কুমার দত্তের । ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করলেও অকাল পিতৃবিয়োগ তাঁকে সাংসারিক জীবনে টেনে আনে, কিন্তু জ্ঞানপিপাসু অক্ষয় কুমার অসীম আগ্রহে গণিত, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন নিজ প্রচেষ্টায় ।সেইসঙ্গে বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজী,ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় দক্ষতা লাভ করেন। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তাঁর কাব্যগ্রন্থ “অনঙ্গমোহন” প্রকাশিত হয়। অক্ষয় কুমারের গদ্য রচনার সূত্রপাত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায়।এই পত্রিকায় তিনি নিয়মিত বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতেন, তার অনেকটাই ইংরেজী প্রবন্ধের অনুবাদ হ’লেও রচনাগুণে তা মনোগ্রাহী হয়ে উঠত। বাংলায় অনুবাদের তাগিদে সেইসময় ও পরবর্তীকালে বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ রচনাকালে তিনি বাংলায় বিজ্ঞানের অনেক প্রতিশব্দ রচনা করেন। অণুবীক্ষণ, দূরবীক্ষণ, চুম্বক, মাধ্যাকর্ষণ, সৌরজগৎ এইসব অসংখ্য বাংলা প্রতিশব্দের জনক অক্ষয় কুমার দত্তের লেখা ‘ভূগোল” (1841) বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞান পুস্তক হিসেবে স্বীকৃত । তাঁর রচিত “পদার্থবিদ্যা”(1856) বাংলা ভাষার প্রথম বিশুদ্ধ বিজ্ঞান পুস্তক । তাঁর লেখা চারুপাঠ (তিনখন্ড) পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। বাহ্যবস্তুর সঙ্গে মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার, ধর্মনীতি, ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় ইত্যাদি তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ । শেষ বইটা ক্ষেত্র সমীক্ষা ও গবেষণামূলক মৌলিক চিন্তাভাবনার ফসল।
তৎকালীন অন্যান্য যুবকদের মতো অক্ষয় কুমার ব্রাহ্ম চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । ১৮৪৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আরো উনিশজন বন্ধুর সাথে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং এরাই হলেন প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম । এরপর তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে তৈরী তত্ত্ববোধিনী সভার সক্রিয় সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৮৪৩ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হলে তিনি তার সম্পাদক হন এবং ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন । এই পত্রিকায় অক্ষয় কুমারের অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, তা যে শুধু ধর্ম বা বিজ্ঞান বিষয়ক তাই নয় তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা ও অনাচার সমন্ধে নির্ভীক মতামত প্রকাশেও তিনি দ্বিধা করতেন না। পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের জমিদারদের হাতে দুর্দশা ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। বাল্যবিবাহ রোধ ও বিধবাবিবাহ প্রচলনে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহযোগী ছিলেন । বিধবা বিবাহের সমর্থনে তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় কয়েকটা প্রবন্ধ প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হন এবং অবশেষে সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন।
পরবর্তীজীবনে অক্ষয় কুমার ধর্মীয় রীতিনীতির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তিবাদী চিন্তাধারা ও মানবতাবাদী উদারপন্থী ভাবধারায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। শেষ জীবনে অসুস্থ অক্ষয় কুমার হাওড়ার বালিতে তাঁর নিজের তৈরী বাগানবাড়ি “শোভনোদ্যান”এ জীবন অতিবাহিত করেন। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বৃক্ষচারা সংগ্রহ করে তিনি তাঁর বাগানে রোপণ করেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে তৈরী এই বাগানের বৃক্ষ,গুল্ম ও লতাদের ল্যাটিন নাম,তাদের গুনাগুন ইত্যাদি দর্শনার্থীদের আগ্রহ ভরে বর্ণনা করতেন। এই বাড়িতেই তিনি তাঁর সংগ্রহের ভূতাত্ত্বিক নিদর্শের এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন ।১৮৮৬ সালের ২৭শে মে এই বাড়িতেই তাঁর মৃত্যু হয়।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী স্বশিক্ষিত অক্ষয় কুমার দত্তের আজ দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী । বাংলা মায়ের বরেণ্য এই সন্তানের অমর স্মৃতির উদ্দেশ্যে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ।