বিদেশ

দেশে দেশে মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ


নিউজ ডেস্ক: চিন্তন নিউজ: ২৭শে অক্টোবর :–।হাজার মাইল দূরের কোনো দেশে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন প্রায় একই বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে, কীভাবে আন্দোলনকে সংগঠিত করা যায় এই নিয়ে বিক্ষোভকারীরা একে অপরের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পায়।

অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিবাদে গত এক সপ্তাহ ধরে লেবাননে সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভের মুখে সোমবার কিছু সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গতকাল বুধবার জাল এল-দিব মহা সড়কে বিক্ষোভ করেন। এসময় লেবাননের সেনাসদস্যরা তাদের ঘিরে রাখেন।

দেশটিতে জরুরি অর্থনৈতিক অবস্থা ঘোষণা, দুর্নীতি, মার্কিন ডলারের সংকট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভয়েস কলে ট্যাক্স যোগ করার পরিকল্পনার প্রতিবাদে লেবাননের হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ সমাবেশ করে আসছে। হোয়াটস আপ ও ম্যাসেঞ্জারে ডাক দেওয়া আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিক্ষোভকারীরা প্রস্তাবিত করের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে প্রতিবাদে অংশ নিতে শুরু করে।

গত কয়েক সপ্তাহে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দেশ যেমন লেবানন, স্পেন ও চিলিতে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপক বিক্ষোভ। এই আন্দোলনগুলোর ধরণ, সেগুলোর কারণ এবং এগুলোর লক্ষ্যের মধ্যে ফারাক থাকলেও কিছু বিষয়ে বিক্ষোভগুলোতে সাযুজ্য রয়েছে।আন্দোলনকারীদের কোন বিষয়গুলোকে পথে নামতে বাধ্য করেছে তার একটা চিত্র এখানে তুলে ধরা হলো।যারা আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তাদের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরেই নিজের দেশে নিজেকে বঞ্চিত মনে করে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ কোনো সেবার মূল্য বৃদ্ধির সরকারি সিদ্ধান্ত এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

এই অক্টোবরেই একুয়েডরে দেখা দেয় প্রবল বিক্ষোভ। সরকারি খরচ কমানোর অংশ হিসেবে সরকার হঠাৎ করেই জ্বালানীতে ভর্তুকি বন্ধ করার ঘোষণা করে দেয়।ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শে অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, বহু বছর ধরে চলে আসা এই ভর্তুকি যখন সরকার বন্ধের ঘোষণা করে, তখনই বিক্ষোভের শুরু।
ভর্তুকি বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পর দেশটিতে পেট্রোলের দাম অনেক বেড়ে যায়। মূল্যবৃদ্ধির এই ভার বহন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় বলে জানিয়েছেন অনেকেই। আদিবাসী গোত্রের বাসিন্দারা আশঙ্কা করছিলেন, জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের দৈনন্দিন যাতায়াত ও খাদ্য খরচ বেড়ে যাবে এবং এর বড় কোপটা পড়বে গ্রামীণ জনগণের ওপর।ফলে, বিক্ষোভকারীরা সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এবং ভর্তুকির দাবীতে আন্দোলনে নেমে রাজপথ বন্ধ করে দেয়, সংসদে হামলে পড়ে এবং নিরাপত্তারক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে জড়ায়। অবশেষে, আন্দোলনের মুখে সরকার পিছু হঠে এবং জ্বালানী তেলে ভর্তুকি বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।

চিলিতে আন্দোলন দানা বাঁধার পেছনেও রয়েছে মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানী তেলের উচ্চ মূল্য এবং দেশটির দুর্বল মুদ্রার কারণ দেখিয়ে চিলি সরকার বাস ও মেট্রোর ভাড়া বাড়িয়ে দেয়।কিন্তু বিক্ষোভকারীদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ছিল গরীবের উপরে সরকারের আরেকটি খাঁড়ার ঘা। গত শুক্রবারে আন্দোলনকারীরা যখন নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, ঠিক সেসময় প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরাকে ইতালিয়ান এক অভিজাত রেস্তোরাঁয় খেতে দেখা যায়। এই ছবিটিকে অনেকেই ব্যাখ্যা করছেন এই বলে যে, চিলির রাজনৈতিক অভিজাতদের সাথে সাধারণ জনতার যে দুস্তর ফারাক দেখা গিয়েছে এটি তারই প্রতিচ্ছবি।দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম ধনী দেশ চিলি। কিন্তু দেশটিতে তীব্রভাবে ধন-বৈষম্য বিরাজমান। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনোমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্টের যে ৩৬টি দেশ রয়েছে তার মধ্যে চিলিতেই সবচেয়ে বেশি আয় বৈষম্য রয়েছে।

একুয়েডরে যেমন জ্বালানী তেলের ভর্তুকি বন্ধের সিদ্ধান্ত সরকার প্রত্যাহার করেছে, চিলিতেও ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সরকার বাতিল করেছে। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা এখন আরো বিবিধ অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্দোলন করছে।কেবল মেট্রোর ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে একটা মামুলী বিক্ষোভ নয়। বরং এটি হচ্ছে বহু বছর ধরে গরীবদের উপরে চলে আসা নিপীড়ন ও জুলুমের প্রতিবাদ’।

লেবাননেও বিক্ষোভ ছড়িয়েছে কর আরোপের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। হোয়াটসঅ্যাপ কলের উপরে কর আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় লেবানিজ সরকার। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা, বৈষম্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে ওঠে।বৈরুতে বিক্ষোভে অংশ নেয়া আব্দুল্লাহ বলছিলেন, ‘শুধু হোয়াটসঅ্যাপের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তারা এখানে আসেনি। এখানে সব কিছুর প্রতিবাদে এসেছে জনগণ— জ্বালানি, খাদ্য, রুটি— সবকিছু’।

যত বিক্ষোভ চলছে তার অধিকাংশের কেন্দ্রে রয়েছে সরকারের দুর্নীতি। দুর্নীতির সাথে বৈষম্যের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।লেবাননে বিক্ষোভকারীরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তাদের যখন জেরবার হচ্ছে তখন দেশের নেতা-নেত্রীরা তাদের পদ-পদবী কাজে লাগিয়ে ঘুষ দুর্নীতিসহ নানান কায়দায় নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত।চলতি সপ্তাহের সোমবারে সরকার একটি সংস্কার প্যাকেজ অনুমোদন দিয়েছে। বিক্ষোভ সামাল দেবার উপায় হিসেবে, এই প্যাকেজের আওতায় রাজনীতিবিদদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

ইরাকেও চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এর ইতি টানার আওয়াজ তুলেছে ইরাকি জনতা।ইরাক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ, মেধার ভিত্তিতে সরকারী কাজে নিয়োগ না দিয়ে জাতিগত ও অন্যান্য বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।বিক্ষোভকারীরা বলছেন, জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করে নেতা-নেত্রীরা নিজেরা এবং তাদের অনুসারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে ‘পাবলিক ফান্ড’ বা সরকারী কোষাগারের অর্থ কোনো কাজেই আসছে না।

চিলি ও লেবাননের বিক্ষোভ, মিশর সরকার এর দুর্নীতির অভিযোগে মিশরীয় সরকারের বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ দানা বাঁধতে উৎসাহিত করেছে।স্পেনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর ডাকে গত সেপ্টেম্বরে মিশরে বিক্ষোভ দেখা দেয়। মি. আলী মিশরীয় প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসি এবং সেনাবাহিনীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন।

সরকারি ফান্ডের টাকা প্রেসিডেন্ট সিসি এবং তার সরকার অপব্যবহার করছে বলে অভিযোগ তোলেন মি. আলী। সরকারের কৃচ্ছতা নীতির কারণে ভোগান্তিতে থাকা সাধারণ মানুষের ছিল একই অভিযোগ।দেশে দেশে এই বিক্ষোভ, পৃথিবী জুড়ে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে একটা সার্বিক ঐক্য গড়ে তুলতে পারে কিনা সেই দিকেই নজর রাখছে রাজনৈতিক মহল ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।