স্বাতী শীল:চিন্তন নিউজ:৪ঠা মে :-“যত ধর্মস্ততো জয়ঃ” মহাভারতে বহুবার ব্যবহৃত এই শব্দের অর্থ হলো যেখানে ন্যায় ধর্ম সেখানেই জয় সুনিশ্চিত আর এই শব্দক’টিকেই কি বীজমন্ত্র হিসাবে বহন করে চলেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, সেই স্বাধীনতার পর থেকেই।আর সেই কারণেই সুপ্রিম কোর্টের দেওয়াল জুড়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে এই কথাটি। কিন্তু এই বিশ্ব মারীর সময়ে কথাটা কি ভীষ্ম পিতামহের কৌরবদের জন্য দেওয়া সদুপদেশ এর মতই তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলল? এই প্রশ্ন কিন্তু প্রতিবেদক এর নয়, এ প্রশ্ন স্বয়ং সংবিধান বিশেষজ্ঞের একাংশের।
একটি বহুল প্রচলিত অনলাইন পত্রিকায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত ভুষন দেশের সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার মতে করোনার আবহে এই লকডাউন পরিসরে দেশের কোটি কোটি বিপন্ন দরিদ্র মানুষের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আরো একটু বেশি সচেতন হওয়া উচিত ছিল। অত্যন্ত কড়া ভাষায় নিন্দা করে তিনি বলেছেন যে, কোটি কোটি হতদরিদ্র মানুষের সাংবিধানিক স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের কাজের ঠিক ভুল এর বিচারের সাংবিধানিক ক্ষমতা খোদ সরকারের হাতেই তুলে দিয়ে কার্যত আত্মসমর্পণ করেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।অত্যন্ত কড়া ভাষায় বলা হলেও প্রশান্ত ভূষণের কথাগুলি কোন একজন ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন মতামত নয়, কারণ তাঁর সমর্থনে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সহমত পোষণ করেছেন। শব্দ প্রয়োগ জনিত খুঁটিনাটি বাদ দিলে তাঁর মূল বক্তব্যকে সর্বান্তকরণে সমর্থন জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মদন লোকুর।
দেশব্যাপী কোরোনা সংক্রমণ রুখতে হঠাৎ করেই পরিকল্পনাবিহীন ভাবে লকডাউন শুরু হয়ে যায়। যার ফলে অপ্রস্তুত অবস্থায় আটকে পড়ে বাইরে কাজ করতে যাওয়া কোটি কোটি মানুষ ও বিশেষত শ্রমিকরা।খাদ্য, বাসস্থান এবং সর্বোপরি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় বারবার সরকারি সাহায্য প্রার্থনা করেও না পেয়ে, শেষ পর্যন্ত এই শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে থাকে পায়ে হেঁটে।এই প্রয়াস চলাকালীন একাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয় পথেই। এদের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে, এই দাবিতে সংবিধান প্রদত্ত জীবনের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনে একটি জনস্বার্থ মামলা রুজু করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট তিন সপ্তাহ ধরে সমানে সরকারকে সময় দিতে থাকে পরিশেষে একুশে এপ্রিল রায় দেয় যে, সরকারের যা যা করণীয় তা যেন করে ।
এ বিষয়ে বিচারপতি লোকুর স্পষ্ট করে বলেন যে,সাধারণত জনস্বার্থ মামলা কোনোভাবেই বিবাদ মূলক বা সরকারবিরোধী নয়।কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আবেদনকারী মামলা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার থেকে সাধারণত মেনে নেওয়া হয় যে সমস্যা রয়েছে এবং সমস্যাটির চরিত্র ও বিন্যাস নিয়ে আদালতে বিবেচনা করা হয় এবং আদালতের ই তত্ত্বাবধানে সরকার ও আবেদনকারী মিলিতভাবে বিষয়টির সঠিক সমাধান সূত্র খুঁজে বার করে। কিন্তু পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি দূরের কথা উল্টে আবেদনকারীর বিরোধিতা করে সরকার বলে যে, কোন ভুল করা হয়নি। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু ঠিকই করা হচ্ছে সুতরাং এই বিষয়ে আদালতের মন্তব্য না করাই শ্রেয়। সরকারের এই ধরণের উক্তির প্রেক্ষিতে যেই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল আদালতের, তার কিছুই নেওয়া হয়নি বলে মনে করেছেন বিচারপতি লোকুর, আর এই কারণেই বিপন্ন মানুষদের এখনো বিচার মেলেনি বলে তিনি মনে করেছেন।
সাংসদ ও বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য এই বিষয়ে বলেছেন যে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই মামলার শুনানির সময় কোর্টে বলেছেন যে ওরা তো খাবার পাচ্ছেন, তাহলে টাকার কি দরকার?,, এ কথাটা বলা ওঁনার অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। যদি এমনটাই হতো তাহলে বিচারপতি বোবদে কেন শুধু মাত্র তার খাবার খরচটুকু নিয়ে বাকি যাবতীয় সুখ-সুবিধা ছেড়ে দিচ্ছেন না? পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়টি কেন্দ্র সরকারের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। যেখানে তিনি মনে করেন যে সরকারের সদিচ্ছার বড়ই অভাব। বিকাশবাবুর মতে,এখনো সময় আছে। শীর্ষ আদালতের উচিত সুয়োমোটো মামলা করে এই শ্রমিকদের ফেরার ব্যাপারে সরকারকে যথাযথ নির্দেশ দেওয়া ও শ্রমিকদের ফেরাবার খরচ সরকারকেই দিতে হবে এই বিষয়ে সঠিক নীতি নির্দেশ করে দেওয়া। না হলে সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে এবং সংবিধানের মূলনীতি লঙ্ঘিত হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সরকার বা প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে এ ঘটনা নতুন নয়।সে ক্ষেত্রে বিক্ষুব্ধ নাগরিক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট।যার রায় সমগ্র দেশব্যাপী সকলেই মানতে বাধ্য, একথা সংবিধান স্বীকৃত। সংক্রমনের এই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির, ‘বর্তমান অবস্থায় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার রক্ষার বিষয়টি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়’,,এই ধরণের মন্তব্য স্বভাবতই দেশের শীর্ষ আদালতের ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।।