বিনোদন রাজ্য

হারমোনিয়ামের ইতিবৃত্ত


শ্রীরূপ গোপাল গোস্বামী, চিন্তন নিউজ, ২৮ মে: হারমোনিয়াম হলো একটি বিদেশী  বাদ্যযন্ত্র। এর উদ্ভব পাশ্চাত্যে হলেও কালক্রমে যন্ত্রটি প্রাচ্যের যন্ত্রতালিকায় বিশেষ স্থান করে নেয়। ১৮৪২ সালে প্যারিসের আলেকজান্ডার ডোরিয়ান এটি আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়। এ বাদ্যযন্ত্রটি ‘ক্যাবিনেট অর্গ্যান’ নামেও পরিচিত।
হারমোনিয়াম দেখতে একটি বাক্সের মতো। বেলোর সাহায্যে ভেতরে বায়ু চালিয়ে যন্ত্রটি বাজাতে হয়। এতে একটি রিডবোর্ড থাকে এবং ধাতব রিডগুলি বোর্ডে সপ্তকের অন্তর্গত স্বরস্থান অনুযায়ী ক্রমোচ্চ পদ্ধতিতে সাজানো থাকে। বেলোর সাহায্যে চালিত বায়ু ভেতরে গিয়ে রিডে আঘাত করে এবং তা থেকে ধ্বনি সৃষ্টি হয়। রিডগুলির উপরে থাকে সাদা ও কালো রঙের পর্দা। সাদা পর্দাগুলি সাধারণত শুদ্ধ স্বর এবং কালোগুলি কোমল স্বর বোঝায়। তবে স্কেল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়।
হারমোনিয়াম প্রথম অবস্থায় Diatonic scale-এ তৈরি করে পাশ্চাত্যে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এই যন্ত্রের চাবিগুলি পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ছিল না বলে নির্দিষ্ট চাবিতে সুর মেলাতে অসুবিধা হতো। এতে শিল্পীর পক্ষে ভিন্ন পর্দায় সঙ্গীত পরিবেশন করা সম্ভব হতো না। পরে এই অসুবিধা দূর করার জন্য ডায়াটোনিক স্কেল পরিবর্তন করে যন্ত্রটিকে সমান স্বরান্তর (equally tempered scale)-এ রূপান্তরিত করা হয়। ফলে যেকোনো চাবিকে ইচ্ছেমতো ‘সা’ করে  সঙ্গীত পরিবেশন করা সহজ হয়ে যায়।
হারমোনিয়ামের চাবিগুলি একটি নির্দিষ্ট স্কেলে বাঁধা থাকায় সঙ্গীত পরিবেশনের সময় নতুন করে সুর বাঁধতে হয় না। এতে হারমোনিয়ামে কণ্ঠশীলন সহজ হয় এবং সম্ভবত এ কারণেই হারমোনিয়াম এদেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে এদেশের কণ্ঠসঙ্গীতে হারমোনিয়াম একটি অপরিহার্য ও বহুল ব্যবহৃত যন্ত্র। এ দেশে বিভিন্ন ধরণের হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হয়, যথা: কপলার হারমোনিয়াম, বক্স হারমোনিয়াম, স্কেল চেঞ্জার হারমোনিয়াম, সিঙ্গল বেলো হারমোনিয়াম, ডবল বেলো হারমোনিয়াম ও সাতপাট বা ইংলিশ বেলো হারমোনিয়াম।
যতদূর জানা যায়, ভারতবর্ষে প্রথম হারমোনিয়াম ব্যবহৃত হয় কলকাতায়। উনিশ শতকের ষাটের দশকে  দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোতে স্থাপিত সখের থিয়েটারে প্রথম হারমোনিয়াম বাজান। বাঙালিদের মধ্যে প্রথমে কৌতূহল এবং পরে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় হারমোনিয়াম শিক্ষা ও তার ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য উপযুক্ত গ্রন্থও রচিত হয়। সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের হারমোনিয়াম সূত্র (১৮৭৪) এবং কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের হারমোনিয়াম শিক্ষা (১৮৯৯) এ বিষয়ে প্রথম ও প্রধান দুটি গ্রন্থ। গ্রন্থ দুটিতে হারমোনিয়াম বাদন সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
দ্বারকানাথ ঘোষ তাঁর বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেছিলেন ১৮৭৫ সালে। বিদেশী কোম্পানি টমাস ডোয়ার্কিন্স-এর কাছ থেকে প্যাডেল হারমোনিয়াম ও অন্যান্য বাদ্য যন্ত্র এনে বিক্রি করতেন। কোম্পানির নাম প্রথমে ছিল ঘোষ এণ্ড কোং। পরে সুকুমার রায়ের বাবা উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর কথা মত দ্বারকানাথ কোম্পানির নাম রেখেছিলেন ডোয়ার্কন এণ্ড সন। এই ভেবে যে, সাহেবী নামের প্রতি দেশী লোকদের একটা মোহ আছে, বিক্রি হবে ভাল।

ডোয়ার্কিন এন্ড সন্সের বিজ্ঞাপন


১৮৮৪ সালে দ্বারকানাথ প্যাডেল হারমনিয়ামের সংস্কার করে এ যুগের বক্স হারমোনিয়াম তৈরি করেন। সে কালে আমাদের দেশে লোকেরা খাওয়াদাওয়া গানবাজনা সব কিছুই করত হাঁটু মুড়ে বসে – চেয়ারে বসার চল তেমন ছিল না । সুতরাং পায়ের প্যাডেলের বদলে হাতে বেলো টিপে হারমোনিয়াম বাজাতে পারলে গায়কদের যে সুবিধা হবে সেটা উনি বুঝতে পেরেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের দেশে লঘু সঙ্গীতের জগতে বক্স বা হাত হারমনিয়ামের স্থান পাকা হয়ে যায়। ডোয়ার্কিন এণ্ড সন-এর পদানুসরণ করে আরও অনেক হারমোনিয়াম নির্মাতা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাদের মধ্যে মেলোডি , পাকড়াশী এণ্ড কোং (১৯২২) এবং শরৎ সর্দার এণ্ড সন্স উল্লেখযোগ্য। প্রসঙ্গত, বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ছিলেন দ্বারকানাথের পৌত্র।
ডোয়ার্কিন এণ্ড সন কোম্পানির খবরের কাগজে দেওয়া একটি বিজ্ঞাপন এই লেখায় যুক্ত করা হলো। কবেকার বিজ্ঞাপন তা সঠিক করে বলা যাবে না। শুধু বলা যায় খুবই পুরানো, – ১৯৫৭* সালের আগে । সেই সময়ে স্কেল-চেঞ্জিং হারমনিয়াম উদ্ভাবিত হয় নি।
(*১৯৫৭ সালে ভারতে দশমিক পদ্ধতি চালু হয়। এক আনা সিকি ইত্যাদি উঠে গিয়ে ‘নয়া’ পয়সা চালু হয়। ১০০ নয়া পয়সায় এক টাকা । ১৯৬৪ থেকে আর ‘নয়া’ কথাটা ব্যবহার করা হত না । )
শোনা যায় ১৯০১ সালে গুজরাট প্রদেশের ভাবনগরের রাজা কৃষ্ণকুমারসিংজি গোহিল একজন ব্রিটিশ মানুষের হারমোনিয়াম সারানোর জন্য দুইজন কামারকে ডেকে পাঠান। জীবনলাল মিস্ত্রি ও মোহনলাল মিস্ত্রি রাজদরবারে হাজির হন। হারমোনিয়াম তারা জীবনে দেখেননি। কিন্তু এই দুইজন তাদের সংগীতের ধারণার ভিত্তিতে সফল ভাবে হারমোনিয়ামটি সারিয়ে ফেলেন।
ভাবনগরের অদূরেই পালিটানা। জৈন ধর্মের এক তীর্থস্থান। এই শহরেও তৈরি হয় ভারত বিখ্যাত হারমোনিয়াম এবং হারমোনিয়ামের রিড। জীবনলাল মিস্ত্রির বর্তমান প্রজন্ম জীতুভাই। তাদের ১১৪ বছরের কারবার। মোহনলালের প্রপৌত্র পরাগ মিস্ত্রিও এই কাজে যুক্ত। তবে পালিটানাতে যার কদর সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন মনোহরভাই পারমার। ৭৫ বছর বয়স। এক ঘুপচি গলির শেষ মাথায় তার দোকান ‘মনোহর মিউজিক্যালস্’। মনোহরভাই- এর ক্রেতা তালিকায় কে নেই। পুরুষোত্তম দাস জালোটা (অনুপ জালোটার বাবা), নৌসাদ, খয়য়াম, প্যারেলাল, মেহেদি হাসান, গুলাম আলি, জগজিৎ সিং, অনুপ জালোটা, হরিহরণ প্রমুখ।
পালিটানা ছাড়াও দিল্লি, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে হারমোনিয়ামের রিড তৈরি হয়। কিন্তু বিশিষ্ট হারমোনিয়াম বাদক ওস্তাদ আখলাক হোসেনের মতে পালিটানার রিড শ্রেষ্ঠ। আগে সবটাই হাতে তৈরি হতো। এখন কিছুটা মেশিনের ব্যবহার হচ্ছে। তবে রিডের টিউনিং এখনও কানের সাহায্যেই করে বিশেষজ্ঞ মিস্ত্রি। কলকাতা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের  হারমোনিয়াম প্রস্ততকারকরাও পালিটানায় তৈরি রীড ব্যবহার করে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।