রঘুনাথ ভট্টাচার্য, চিন্তন নিউজ, ২৯মে: গত কয়েকদিনের খবরের বাজার জমজমাট। অতি উৎসাহে, আর অন্য কিছু পড়ার সময় করেই উঠতে পারছি না। ভোট, তার ফলাফল, পরবর্তী হিংসা, মারামারি- খুনোখুনি, মন্ত্রিসভা, কী হতে পারত কিন্তু কেন হয় নি, কোন দলের কী ভবিষ্যৎ, ইত্যাদি নানা মৌতাতি বিষয়ে বিভিন্ন রঙে রঙিন বিজ্ঞজনের মতামত, ইত্যাদিতে একেবারে নরক-গুলজার। এরমধ্যে মন কাড়ছে সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতির খবরগুলো।
কারন, আর যা সব, যথা সারদা-নারদ- রাফাল-নোট-স্বচ্ছ ভারত-ভোট কাটাকাটি-নীরব-চোক্সি-রাজীব কুমার এ সবে চিন্তা নেই; এসব গত। এঁদের ফল নিয়ে ধ্যান করার মত , দরকার বোঝার মত, বুদ্ধি যদি আমাদের থাকত তবে তো আমাদের লোকে বুদ্ধিজীবী বলত! কিন্তু, হাওয়া গরম করে দাঙ্গা লাগালে (মানে, দাঙ্গা তো শুধু ভাইয়ে ভাইয়েই হয় কিনা! আর, আমরা তো শুধু দুই ভাই, তাই আমাদের মধ্যে দাঙ্গা লাগান খুব সোজা, ‘ওই, তোর কান চিলে নিয়ে গেছে’ বললেই লেগে গেল দাঙ্গা)। তখন তো মামা-মেসোরা দুরে দাঁড়িয়ে মজা দেখবে, আর
আমাদের জান-মান নিয়ে হোলি খেলবে। তাই , দাঙ্গার মেঘ দেখলেই বুক ঢিপঢিপ করে।
এই সব ভারী ভারী ভাবনায় মনটা যখন কাবু হয়ে আসছে, তখন সে মেঘের ফাঁকে এক চিলতে রোদ্দুর হয়ে উঠলো এক কোনায় পড়ে থাকা
টুকরো খবর। কী ব্যাপার, না, ‘ কাগজ কুড়ানি জিতেন মাধ্যমিকে স্টার’ (আবাপ/২৮.০৫)। সারা গায়ে ধুলো মাখা একটা ছেলে রাস্তা থেকে কাগজ কুড়োচ্ছে। আর সেই কাগজটাই মন দিয়ে পড়ছে। পড়া হয়ে গেলে সেই কাগজটা ঝোলায় রেখে আবার ছেঁড়া কাগজ খোঁজা। মধুর গায়ে মৌমাছির মত আটকে গেলেন মহম্মদ মুসা। তারপর তিনিও ছেঁড়া কাগজ খোঁজার মত জিতেন টুডুকে পড়ে ফেললেন আর তাঁর ঝোলায় তুলে নিলেন। জিতেন টুডুর বাড়ি মুসার পাশের গ্রামেই। জিতেনের বাবা-মা তাকে ছেড়ে চলে গেছে সেই কোন শৈশবে। জিতেন দিদা ফুলমনিকেই মা বলে চিনত তিন বছর বয়েস থেকে।
মুসা নিজে নিতান্তই স্বল্পবিত্ত চাষি। থাকেন উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ায়। জিতেন টুডু থাকত পাশের গ্রাম গোয়ালগাওয়ে। স্থানীয় প্রাইমারিতে ভর্তি হওয়াই যা (বোধ হয়, পেটের তাগিদেই), স্কুলে আর যাওয়া হয় না।
তখনই মুসার আবির্ভাব, কী বলব, ভাগ্যাকাশে ! মুসা গিয়ে ফুলমনির সঙ্গে কথা বলে জিতেনকে তাঁর বাড়িতে। রূপকথা শেষ হয় না। মহম্মদ মুসা ও স্ত্রী রহিমা বিবির চার সন্তান। গ্রামের মহিলা, নিতান্তই নিম্নবিত্ত পরিবারের। তিনি কী বলছেন ?
“জিতেনও আমাদের সন্তান। এই সংসারের সুখ-দুঃখ , জিতেনেরও সুখ-দুঃখ।” জিতেনেরও কথা তাই। “আমার জন্মদাতা বাবা-মা কোথায় জানি না। কিন্তু তার পরে বাবা পেয়েছি, মা পেয়েছি, সংসার, ভাই-বোন পেয়েছি। এবার আমারও ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। আমি ভাল করে পড়াশোনা করে যেতে চাই। পরে শিক্ষকতা করব”। খুশি ফুলমনি। সর্বোপরি, স্থানীয়
বাসিন্দারাও এই সম্পর্ক স্বীকার করে নিয়েছেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাসুদেব দে বললেন, “জিতুর জন্য যত গর্ব হচ্ছে, মুসার জন্য তার চেয়ে কম হচ্ছে না। আজ মুসারই জয়ের দিন।” বাহ্! এই প্রেম কি ছড়িয়ে পড়বে না।
আমি মনে মনে প্রণাম করলাম সেই মহিলাকে, যিনি নিজের চার সন্তানের মুখের ভাত তাঁর পঞ্চম তথাকথিত বিধর্মী, পালিত সন্তানটিকে ভাগ করে দিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। হাসিমুখে, স্নেহের সুখে।
আমার গর্ব হচ্ছে সেই গ্রামীন সমাজের জন্য, যে মাটিতে এই অসীম উজ্জ্বল মানবিকতা চেতনা সতেজ বটগাছের মত মহীরুহ হয়ে উঠেছে।
আমার মন ভারী হয়ে উঠছে আর একটা শহুরে জিজ্ঞাসায় – “এই স্বর্গীয় সুষমায় কি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের চিত্ত শুদ্ধ হবে না। তাঁরা তাঁদের বিভেদ-ব্যবসা চালিয়েই যাবেন জনসাধারণের সর্বনাশ সাধনের নেশায়?”