কলমের খোঁচা রাজ্য

কুমোরটুলির উদ্ভবের ইতিহাস।


সূপর্ণা রায়:চিন্তন নিউজ :২১শে সেপ্টেম্বর:–২৩শে এপ্রিল ১৬৯০ ঔরঙ্গজেব ইংরেজদের ভারতে বানিজ্য করার অনুমতি দেয়।। বছরে ৩০০০ টাকার বিনিময়ে এই অনুমতি দেওয়া হয়।।১৬৯০সালের ২৪ শে অগাস্ট ত্রিশজনের একটা দল নিয়ে সুতানটিতে পা রাখেন জব চার্নক।। সুতানটির পাশের গ্রাম কলকাতাতে হ’ল কোম্পানির প্রধান বানিজ্য কুঠি।। শুরু হল বেনিয়া ইংরেজদের খেলা।। তখনও বনিকের মানদন্ড পরিনত হয়নি রাজদণ্ডে।। ১৬৯৮ সালের ১০ই নভেম্বর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সাবর্ণ রায়চৌধুরীর কাছ থেকে সুতানটি-,কলকাতা,-গোবিন্দপুর কিনে নেয়১৩০০ টাকার বিনিময়ে।।তখনও কিন্তু নগরয়ান শুরু হয়নি।

পুরো পরিকল্পনাহীনভাবে ইংরেজরা শহরের পত্তন শুরু করে।। সুতানটি এখন কার বড়বাজার আর গোবিন্দপুরে নির্মান করে ফোর্ট উলিয়াম দুর্গ। ১৭৫৭ সালে স্বাধীনতানতার সূর্য অস্তমিত হল। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পতনে শুরু হয় পটপরিবর্তন।। সেই সময় কোম্পানীর অশ্বমেধ ছুটছে জোরকদমে আর গ্রামগঞ্জ থেকে মানুষ এসে ভীড় জমাতে শুরু করতে লাগলো কলকাতাতে।।পেশা ভিত্তিক পাড়া বিভক্ত হল,যেমন শুড়ি পাড়া,কলুটোলা,ছুতার পাড়া,এবং কুমোর টুলি।
এভাবেই কুমোরটুলির উদ্ভব ঘটে।যে সকল জনগন কলকাতাতে বসবাস শুরু করেছিল তাদের প্রয়োজনীয় হাঁড়ি,কলসি,ঘটি, বাটি, থালা এগুলির জোগান দিতে থাকে কুমোড়টুলির শিল্পীরা।। নদিয়ার কৃষননগর প্রভৃতি জায়গা থেকে পুতুল গড়ার কারিগর এখানে এসে বাস শুরু করলেন রুটিরুজির আশাতে।।তারপর কালের নিয়মে মাটির বাসন গুরুত্ব হারাতে লাগল, এল কাসা পিতলের বাসন।।

এবার সমস্যাতে কুমোরর।যারা পুতুল বানাতেন তারা পুতুল বানিয়ে সুতানটি বাজারে বিক্রি করতে লাগল।।পলাশীর যুদ্ধের হারের পর বাংলার ক্ষমতা পুরোপুরি ইষ্ট্ ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে চলে গেল।। বানিজ্য কেন্দ্র হয়ে গেল কলকাতা।।আর তাদের ঘিরেই তৈরী হ’ল একদল লোভী—-অলস—–নাগরিক সমাজ। আঠার শতকের কলকাতা ছিল দালাল, মুতসুদ্দি, বেনিয়াদের কলকাতা। নতুন সমাজ এল “”” বাবু সমাজ”””….. এই সব ধনী সম্প্রদায়ের বাড়ীর পুজোর দেবদেবী মুর্তি তৈরী করতে লাগল এবার তথাকথিত কুমোররা। কুমোরটুলি তৈরীহল প্রতিমা তৈরীর প্রানকেন্দ্র।।

সময় যত এগিয়েছে কলকাতার পুজোর সংখ্যা তত বেড়েছে। কিন্তু তখন মুর্তির পরিবর্তন তেমন ঘটেনি, কারন সবই ছিল পারিবারিক পুজো।।

রঙ তুলির পাঁচালী, ঝাঁ চকচকে কলকাতার একপাশে এক নিঃশব্দ কলকাতা, তিলোত্তমার এই অংশের নাম কুমোরটুলি। এখানে নেই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বা নেই শ্বেত পাথরের মেঝে—-আছে শুধু শিল্পীর হার না মানা লড়াই।। ইট কংক্রিটের দুনিয়ায় এক মাটির ভুবন।। কুমোরটুলি পল্লি- সরু তস্য সরু গলি——আর এখানেই উমা মৃন্ময়ীরুপ নিচ্ছেন তার চার সন্তান কে নিয়ে।।। মন্ডপে যাবেন আর কিছুদিন পর। -তার আগে ঘরের মেয়ে উমা কে তিল তিল করে সাজাচ্ছে মৃতশিল্পীরা। মুর্তি গড়া প্রায় শেষ এখন শুধু রং-তুলির কেরামতি।।

ইতিহাসের আতুরঘর এই ঘিঞ্জি গলি—-কিন্তু এর সাথে জড়িয়ে আছে কতো অতীত, কতো গৌরবগাথা। মুর্তি গড়ার সময় অনেকেই যায় মাটির গন্ধ নিতে ——নেয় পুজো আসছে তার গন্ধ । কিন্তু একটা কথা না বললেই নয় আগে এখানে মুর্তি গড়া হত না, ।মাটির হাড়ি —–কলসি —–মাটির গ্লাস এগুলো বানানো হত।।। কিন্তু পরে এগুলোর ব্যাবহার কমে যাওয়াতে যারা পুতুল বানাত তারা মুর্তি বানাতে আরম্ভ করে।। প্রথমে প্রতিমা ছিল একচালা, প্রতিবছর মুর্তির মুখ থাকত একরকম।।। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল… ১৯৩১ সালে শুরু হয় কুমোর টুলি সার্বজনীন।। কুমোরটুলির শিল্পিরা মিলে এই পুজো শুরু করে।। এই পুজোর সভাপতি হন হরিশংকর পাল,নেতাজীর কাছে প্রস্তাব যায় এই পুজোর সভাপতি হবার জন্য, কিন্তু যেখানে ইংরেজ আছে সেখানে তিনি অংশগ্রহণ করবেন না বলে জানিয়ে দেন।।কিন্তু তরুন বাহিনী ছিল নাছোড় বান্দা—-তখন হরিশংকর নিজেই সরে দাঁড়ান আর ১৯৩৮সালে নেতাজী হ’লেন কুমোর টুলির সর্বজনীন পুজোর প্রথম সভাপতি।।। কিন্তু এতে অনেকের আপত্তি ছিল কারন কেউই ব্রিটিশদের বিরাগভাজন হতে চাইছিলেন না।। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে নেতাজীই সভাপতি হলেন।
দেখতে দেখতে পুজোরদিন চলে এল। পঞ্চমীর দিন ঘটে গেল মহাবিপত্তি।। ততক্ষন মন্ডপে একচালার দেবী প্রতিমা—-হঠাৎ গেল আগুন লেগে,-প্রতিমা পুড়ে ছাই কিন্তু পরের দিন যে বোধন।।। তবে কি পুজো বন্ধ? হাল ছাড়তে রাজী নয় তরুনরা। পাড়াতেই থাকতেন শিল্পী গোপেশ্বর পাল।
বিদেশ থেকে অনেক কিছু শিখে এসেছিলেন কিন্তু ভীষন ভাবে স্বদেশী ——তিনি নিলেন দায়িত্ব——নিজে গড়লেন প্রতিমা—-একচালা ভেঙ্গে তৈরী হল পাঁচচালা। দেবীপক্ষ-অপরুপ মায়ের মুর্তি। যা সম্ভব হ’ল শিল্পী গোপেশ্বরের জন্যই।।এভাবেই মুর্তি পুজোর প্রচলন।। পুজোর মাসদুয়েক আগে থেকে নদীয়া,-হুগলী,কৃষননগর প্রভৃতি এলাকা থেকে কুমোরদল চলে আসে—–কিন্তু তাদের অভাব জাঁকজমকের আড়ালে চাপা পড়ে থাকে——–

মৃৎশিল্পী
দুর্গার মূর্তি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।