কলমের খোঁচা

ঐতিহাসিক ২১ শে জুন,প্রাসঙ্গিক কয়েকটি কথা – সঞ্জীব বর্মণ


চিন্তন নিউজ:২১শে জুন:- যে অতীত তার গৌরবের উজ্জ্বলতা আর ব্যতিক্রমী ঐতিহ্যের স্বকীয়তায় মানুষের চেতনায় নিজের স্থায়ী জায়গা করে নেয় এবং এক ঋগ্ধ ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে অভ্রভেদী ঋজুতায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে, খুশিমতো চাইলেই যাকে ইতিহাস থেকে বিযুক্ত করা যায় না- সেইরকমই একটি ব্যতিক্রমী ঐতিহ্যের স্বকীয়তায় উজ্জ্বল ইতিহাসের মাইলফলক পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ একাদিক্রমে চৌত্রিশ বছর বামফ্রন্ট সরকারের উপস্থিতি। যার শুরুর ঐতিহাসিক দিনটি ছিল ২১ শে জুন। যে সরকারের সঙ্গে দিল্লীতে বিজেপি বা রাজ্যে তৃণমূল পরিচালিত সরকারের অন্ধকারময় কলঙ্কিত অধ্যায়ের কোনো তুলনাই চলে না। যাকে তিলে তিলে শেষ করার হাজার অপচেষ্টা করলে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে হয়তো জায়গা মিললেও মিলতে পারে কিন্তু ইতিহাস কখনই তা বরদাস্ত করবে না, জায়গাও দেবেনা। সে প্রত্যাঘাতের সর্বশক্তি নিয়ে রুখেই দাঁড়াবে ।

“বু্র্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক বিজয় অর্জনের জন্য সংসদ বহির্ভূত সংগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়েই গণসংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে এরাজ্যে দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার ও বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। সংসদ বহির্ভূত সংগ্রাম ছাড়া এই সরকার গুলির অবস্থান কল্পনাও করা যায় না। ”(সূর্য মিশ্র, শারদ সংখ্যা গণশক্তি, ২০১৫ পৃ-৭)। বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে স্বৈরতন্ত্রের হাতে অবরূদ্ধ, ক্ষতবিক্ষত গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার জেদ ও আত্মত্যাগের মহান আদর্শ লাঞ্ছিত লড়াই সংগ্রামের এক দীর্ঘ বন্ধুর পথ পরিক্রমার শীর্ষে ১৯৭৭ সালের ২১ শে জুন এই রাজ্যে গঠিত হয়েছিল ’৬৭ ও ’৬৯ সালের দু’ দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত বামফ্রন্ট সরকার।

অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক যেকোন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের প্রধানতম শর্ত হলো শান্তি, সম্প্রীতি এবং গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুরক্ষিত, সংহত ও প্রসারিত করা। এই দায়িত্ব পালনের দৃঢ় সংকল্প ও অঙ্গীকারই ঝরে পড়েছিল শপথ নেওয়ার পরের দিন অর্থাৎ ২২ জুন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এবং দেশের জনপ্রিয়তম জননেতা জ্যোতি বসুর আবেগময় অথচ দৃঢ়, সুস্পষ্ট বক্তব্যে,“স্বৈরতন্ত্র, সন্ত্রাস ও দমননীতিকে পরাস্ত করেছেন জনগণ, জনগণের সংগ্রামের ফলশ্রুতিই এই বামফ্রন্ট সরকার। গণতান্ত্রিক অধিকার,ব্যক্তি স্বাধীনতা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনার পক্ষে জনগণ স্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বামফ্রন্ট সরকারের অন্যতম নীতি হচ্ছে সমস্ত নাগরিককে গণতান্ত্রিক অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং মেহনতী জনগণকে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। বিরোধী দল গুলিসহ সকল রাজনৈতিক দলের ও জনগণের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকারকে দৃঢ়ভাবে সুনিশ্চিত করাও এই সরকারের নীতি।”প্রতিটি পদক্ষেপে জনউদ্যোগ ও জনচেতনার সংশ্লেষণে সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার গুলিকে বিকাশের কার্যকরী পদক্ষেপের মধ্যদিয়ে যতটা সম্ভব জনকল্যাণ মূলক কাজে সক্রিয় থাকার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারাই পরবর্তী ৩৪ বছর মূলগতভাবে বামফ্রন্ট সরকার যে পরিচালিত হওয়ার চেষ্টা করেছে ঘোরতর বামপন্থা বিরোধীও কি তা অস্বীকার করতে পারেন ? বারবার স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে দেখলেও সামান্যতম ক্লীশে হয়ে যায় না বরং নতুন নতুন শিক্ষার উজ্জ্বল আলোয় চেতনাকে উদ্ভাসিত করে এবং উদ্ভূত নতুন পরিস্থিতি ও পরিবেশে সংগ্রামের দিকনির্ণায়ক হিসাবে সামনে এসে দাঁড়ায় যে ঐতিহাসিক দলিল তারই পুনর্পাঠের বা ফিরে দেখার আকাঙ্খায় বিগত বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের গৌরবজ্জ্বল অবস্থানের একটি রূপরেখা উপস্থিত করার আগে দেশে ও রাজ্যে বর্তমান চালু দুটি সরকারের কার্যধারার একটি সংক্ষিপ্ত সারাৎসার শুধু তুলনামূলক আলোচনার প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা বিচারের মধ্যে রেখেই উল্লেখ করা দরকার। সংগ্রামের মধ্যে থাকা লড়াকু পাঠক কমরেড গণ যা নিয়ে সব সময় কথা বলছেন, সোচ্চার হচ্ছেন তার পুনরুল্লেখে বিরক্ত হবেন বোধকরি তথাপি লেখকের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে মার্জনাও করেন ভরসা করি।

দেশের বর্তমান আরএসএস নিয়ন্ত্রিত, বিজেপি পরিচালিত সরকারের অবস্থানের দার্শনিক ভিত্তিভূমির আসল আদলটি কি রকম ? (নিজনিজ অভিজ্ঞতায় মিলিয়ে দেখা যেতে পারে) (ক) কর্পোরেট পুঁজি ও সাম্প্রদায়িক শক্তি উভয়ের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের উগ্র প্রচার, (খ) অর্থনীতির ক্ষেত্রে নয়া উদারবাদী নীতির অবাধ প্রয়োগে বল্গাহীন পদক্ষেপ, (গ) যুক্তিবোধ, সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক বিশ্বাসের পরম্পরাকে ধ্বংস করা, (ঘ) মতাদর্শের জগতে তর্কাতীত অসহিষ্ণু একাধিপত্য বিস্তার করা, (ঙ) দেশের স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে প্রকাশ্যে অসন্মান করা ও অস্বীকার করা, (চ) শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে উচ্চশিক্ষা ও দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গুলির শীর্ষে নীতি নির্ধারক ও পরিচালক হিসাবে নিজেদের জোহুজুর ঘনিষ্ঠ দের বসানো এবং (ছ) দেশের ভেতরে প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে নিরঙ্কুশ গেরুয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। ২০১৪ সাল থেকে দেশে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে এই সরকারের চলার মূল অভিমুখ কী তাদের, অর্থাৎ এরএসএসের দার্শনিক ভিত্তিভূমি থেকে পৃথক ? (এটাও অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে )দেখা যাক, (১) লুঠেরা ধনকুবেরদের বাটপাড়ির পুরস্কার স্বরূপ ফি বছর লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা কর ছাড় আর সাধারণ ভারতীয় নাগরিকদের ওপর সীমাহীন করের বোঝা, (২) সংসদকে এড়িয়ে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পথ অগ্রাহ্য করে বৃহৎ পুজির আবদার মেটাতে অর্ডিন্যান্স জারি,(৩) পেট্রো পণ্য সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পড়ানোর ব্যবস্থা না করে উল্টে গোটা গণবন্টন ব্যবস্থাকেই ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া, (৪) রেল, ব্যাঙ্ক, বীমা ও প্রতিরক্ষায় বিলগ্নীকরণকে অবশ্য পালনীয় পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করা, (৫) পুঁজিপতিদের লোভের কাছে আত্মসমর্পণ করে নীলামের মাধ্যমে জলের দামে খনি, খনিজ সম্পদ বিক্রী করে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে গর্ব অনুভব করা, (৬) শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে শ্রমআইন সংশোধন করে যৎসামান্য যা অবশিষ্ট আছে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের ব্যাপক সংকোচন করে কার্যত তাও শেষ করে দেওয়া, (৭) দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রমশক্তিকে নুন্যতম সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা, (৮) কৃষি জমির কেন্দ্রীভবন ঘটিয়ে কৃষকের হাত থেকে জমি কেড়ে নিয়ে জলের দামে ধনী কর্পোরেট মালিকদের হাতে সমর্পণ, কৃষি ক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগ এবং কৃষিতে উৎপাদন খরচ ও বিক্রয়মূল্যের ব্যাপক ব্যবধান ঘুচিয়ে কৃষক স্বার্থ সুরক্ষাকে বিলাসিতা বিবেচনা করে, সরকারী ভুমিকার মৃত্যু ঘোষণা করে ‘ কৃষক ভিত্তিক কৃষি থেকে কর্পোরেট ভিত্তিক কৃষিতে রূপান্তর সুনিশ্চিত করা, (৯) একশ দিনের কাজে ক্রমশ বরাদ্দ হ্রাস (১০) এর আবশ্যিক পরিণতিতে ধান্দার ধনতন্ত্রের গর্ভজাত সর্বোচ্চ পর্যায়ের সীমাহীন দুর্নীতি, চুড়ান্ত লুঠ ও নানা কিসিমের আর্থিক কেলেঙ্কারিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া ও সর্বত্রগামী,সর্বগ্রাসী করা এবং ১১) চরম উগ্র হিন্দুত্ববাদকে সামনে রেখে ফ্যাসিবাদী কায়দা অবলম্বন করে উগ্র ও হিংসাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হানতে রাষ্ট্রশক্তির নির্লজ্জ ব্যবহার। উদাহরণ আশাকরি নিষ্প্রয়োজন। এর পাশাপাশি এই রাজ্যে মোদী-মমতা সখ্যের সুখবিলাসে তৃণমূল পরিচালিত সরকারের চালিকাশক্তির মূলমন্ত্র এবং রাজ্যের শাসকদল ও দিল্লীর শাসক দলের সুম্পর্কের দার্শনিক ভিত্তিও আমাদের আরো একবার স্মরণ করা দরকার। তা হলো, “তুমি আমাকে রাজ্যের সব কেলেঙ্কারি থেকে মুক্তি দাও, আমি তোমাকে সব অপকর্মে মদত দেব।” অনতি অতীত ঘটনাপ্রবাহ সঞ্জাত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাদের তাই বলে না ? আজ পশ্চিমবঙ্গে গরিব কৃষক, ক্ষেতমজুর,মধ্যবিত্ত, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, সংগঠিত শ্রমিক, বস্তিবাসী, পার্শ্বশিক্ষক, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী, সংস্কৃতি কর্মী, আশা-মিডডে মিল-আইসিডিএস কর্মী, টেট পরিক্ষার্থী, সিভিক পুলিশ (স্বেচ্ছাসেবক), চিটফান্ডে সর্বস্বান্ত আমানতকারী, ঠিকা শ্রমিক, মহিলা-যুব-ছাত্র-কর্মচারী —জনসমাজের একটি অংশও কি বলতে পারেন তারা ভালো আছেন ? বলার মতো কোনোএকটি দিকেও ভালো আছেন ? নারীর সম্মান, সম্ভ্রম ও নিরাপত্তা কী আজ এই রাজ্যে শাসকদলের মদতপুষ্ট হিংস্র হায়না দের হাতে বন্ধক হয়ে যায় নি ? গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করাই কী আজ মাননীয়ার ও তাঁর সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত কর্মসূচী হয়ে দাঁড়ায় নি ? দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি, তোলাবাজি, মস্তানি, সিন্ডিকেটরাজ ইত্যাদি কে নিয়মে পরিণত করে গুন্ডা-বদমাস, দুষ্কৃতি, লুম্পেন-লুটেরা, সমাজবিরোধী পরিবেষ্টিত এক জঙ্গলরাজ কি কায়েম হয়নি আজকের নৈরাজ্যের দিনলিপি লেখা পশ্চিমবঙ্গে ? দশ হাজার মাদ্রাসা, ৫৬ টি মার্কেটিং হাব, সাকরাইলে জরিহাব, ডোমজুড়ে স্বর্ণ শিল্পীদের জন্যে হাব যেখানে নাকি এক লক্ষের বেশী সংখ্যালঘু মানুষের কর্মসংস্থান হবে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের জন্যে এই একশ দশ শতাংশ মিথ্যা প্রতিশ্রুতিগুলি কি আজ বিশ্বাসঘাতকতা আর তঞ্চকতার অশ্লীল উদাহরণ হয়ে এই রাজ্যের আকাশ বাতাস ভারী করে তুলছে না ? এই জমানায় ছুরি দেখিয়ে প্রত্যাহার করানো হয়েছে ন্যায্য দাবীতে মাদ্রাসা শিক্ষকদের অনশন, একি খুব গর্বের উদাহরণ ? নির্বাচন গুলিকে প্রহসনে পরিণত করে ভোট লুঠকেও দলীয় গুন্ডাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বানানো হয়েছে একি অসত্য ? সুতরাং বর্তমানের দুটি সরকারের এই অসামান্য কীর্তির প্রেক্ষাপটেই আমাদের বিচার করতে হবে অনতি অতীতের বামফ্রন্ট সরকারকে, তা নাহলে স্থুলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। “আর্থিক ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারের অন্যতম প্রধান অবদান ভূমিসংস্কার। কয়েকশ’ বছরের জমিদারি প্রথায় জগদ্দল পাথরের তলায় চাপা পড়ে থাকা নির্মম শোষণে জর্জরিত কৃষকের জীবনে এক নতুন আলো নিয়ে এলো জমির জন্য এই সংগ্রাম। জমি গেল গরিব কৃষকের হাতে। কৃষি উৎপাদনে এলো জোয়ার। সারা দেশে ধান উৎপাদনে রাজ্য প্রথম স্থান অধিকার করল। ক্ষেতমজুরদের মজুরি বাড়লো। দেশে দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী জনসংখ্যা সর্বাপেক্ষা দ্রুত গতিতে হ্রাস পেল এই রাজ্যে। ”( নিরুপম সেন, শারদ দেশহিতৈষী ২০১৫, পৃ-৫২)। বামফ্রন্ট সরকারের গর্বিত ঘোষণা ছিল, “ভূমিসংস্কার কৃষকের প্রতি দয়া নয় দায়িত্ব।” এবং বলা বাহুল্য এর ফলে অধীক ও উন্নত উৎপাদন ক্ষমতার অধিকারী শ্রমশীল কৃষকের ‘ক্ষতি’ নয় স্বপ্নপূরণই হয়েছিল একথা না বললেও বোধহয় চলে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের জমানায় ভূমিসংস্কার কর্মসূচী যেভাবে হয়েছে আজ পর্যন্ত সারা দেশে তার কোনো দ্বিতীয় উদাহরণ আছে ? দেশের কৃষি জমির মাত্র ৩ শতাংশ এই রাজ্যে অথচ দেশে মোট বন্টিত জমির ২০ শতাংশই এই রাজ্যে। গোটা দেশে ভূমি সংস্কার থেকে উপকৃত পরিবারের ৫২ শতাংশই এই পশ্চিমবঙ্গের। এর সুফল ভোগ করে ছিলেন যাঁরা তাঁদের ৭২ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক যাদের অধিকাংশই তপশিলি জাতি, আদিবাসী ও সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের। এর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ১৮ শতাংশেরও বেশী । প্রকৃতপক্ষে ভূমিসংস্কারই দেশের মধ্যে বামফ্রন্ট সরকারকে অনন্য করে তুলেছিল। গণসংগ্রাম, গণউদ্যোগ আর বামফ্রন্ট সরকারের সদিচ্ছার ফলেই যে এটা সম্ভব হয়েছিল এটা বুঝবার জন্যে খুব পন্ডিত হতে হয়?বামফ্রন্টের সময়ে রাজ্যে গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিতে যে অতুলনীয় সাফল্য এসেছিল (বর্তমানে যার ধ্বংসলীলা চলছে) তার মূলে রয়েছে ভূমিসম্পর্কের এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। ভূমি সংস্কারের এই সাফল্যের শক্তিতেই কোমর সোজা করে বামফ্রন্টের আমলেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ক্রমশ অগ্রসর হয়েছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা যা সারা দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দলমত নির্বিশেষে তপশিলি জাতি, উপজাতি ও সংখ্যালঘু ও মহিলা এই অংশের অনুকূলে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ইতিবাচক পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া এতাবৎকাল বহাল সমাজের পিছিয়ে পড়া ও দুর্বলতর অংশকে উন্ননের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত করে তুলতে পেরেছিল। গ্রামীণ শ্রমজীবি মানুষের চেতনায় এনেছিল বিপুল পরিবর্তন। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতি শুধু গ্রামীণ অর্থনীতীতে নয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য ও গ্রামোন্নয়নেও অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছিল। আক্ষরিক অর্থেই এই প্রক্রিয়া হলো “অংশগ্রহণ মূলক গণতন্ত্র থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের রূপান্তর।” ভূমিসংস্কার, কৃষির বিকাশ, পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার সম্প্রসারণ,গ্রামোন্নয়ন, শিক্ষার সম্প্রসারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক গুণগত পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়েছিল। বৃদ্ধি পেয়েছিল মানুষের ক্রয় ক্ষমতা। গ্রামাঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার আভ্যন্তরীণ বাজার। যা কিনা এই রাজ্যে শিল্প সম্ভাবনার ভিত্তি রচনা করেছিল। আজ হয়তো অনেকের কাছে গল্প কথা মনে হবে কিন্তু এই বাস্তবোচিত সম্ভবনাকেই ফলপ্রসু করার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়েই বামফন্ট সরকার মনোনিবেশ করেছিল ক্ষুদ্র কুটির শিল্প, কৃষিভিত্তিক শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, মৎস্য চাষ, পশুপালন ইত্যাদি নিবিড় কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্পে। এর পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় নীতির কারনে দেশব্যাপী ক্রমবর্ধমান কর্মহীনতার প্রেক্ষপটে ব্যাপকতম কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে এবং সীমাবদ্ধতাকে সদিচ্ছার শক্তিতে অতিক্রম করার প্রতিজ্ঞায়, কৃষি উৎপাদনের সাফল্যের ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠা ও ক্রমবর্ধমান আভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর ভিত্তি করে বামফ্রন্ট সরকার উদ্যোগী হয় ভারী শিল্প স্থাপনে। জ্যোতি বসু ঘোষণা করেন বামফ্রন্ট সরকারের মূলত ভারি শিল্প স্থাপন সম্পর্কিত নীতি ও কর্মসূচী। অন্যায় লাইসেন্স প্রথা, বঞ্চনার মাশুল সমীকরণ এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে রাজ্যের অর্থনীতিতে উদারনীতির ধাক্কা এই দুরুহ বাধা গুলিকে অতিক্রম করেই বামফ্রন্ট সরকার কে রাজ্যে শিল্প স্থাপনে অগ্রসর হতে হয়েছে। কখনই ভুলে গেলে চলবে না,শুধুমাত্র, হ্যাঁ শুধুমাত্র হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের অনুমোদন পেতে সময় লেগেছিল ১২ বছর। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তাও বামফ্রন্ট সরকারকে রাজ্যবাসীর সহায়তায় একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলতে হয়েছিল। এতদসত্ত্বেও রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন ইস্পাত, বিদ্যুৎ, তথ্য প্রযুক্তি, অটোমোবাইল, পেট্রোরসায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পেয়েছে কর্মসংস্থানের সম্ভবনাও। একমাত্র রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার বিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিংস্র স্বৈরাচার আর কদর্য রাক্ষসী চেহারার, গণতন্ত্রের সুদূরপ্রসারী বিপদের বার্তাবাহী চরম প্রতিক্রিয়াশীল এবং ফ্যাসিষ্টসুলভ ঝটিকাবাহিনী তৃণমূল কংগ্রেসের বিশৃঙ্খল, ধ্বংসাত্মক রাজনীতিই বামফ্রন্ট জমানায় শিল্প স্থাপনের আরো সম্ভাবনা ও তার বাস্তবায়নকে প্রথম বাধার সম্মুখিন করে। সিঙ্গুর যার সবচাইতে বড় প্রমাণ। নিবিড় কর্মসংস্থানে সক্ষম আশি শতাংশ শেষ হয়ে যাওয়া একটি কারখানাকে কিভাবে শুধুমাত্র ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতির ওপর নির্ভর করে শ্মশানে পরিণত করা যায় তার প্রকৃষ্ঠতম নবুদ সিঙ্গুর। যে ট্রাডিশন্ গত নয় বছর ধরে সমানে চলেছে। তোলাবাজির দাপটে শিল্প পাত্তারি গুটিয়ে রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে, বিনিময়ে তোলাবাজিই হয়ে গেছে রাজ্যের প্রধান শিল্প। অতএব ইতি টানার আগে পশ্চিমবঙ্গে টানা ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে একথা বলাই যায় শ্রমজীবি মানুষের ক্ষমতায়ন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সুস্থ চিন্তা,চেতনার উন্মেষ বামফ্রন্ট সরকারকে মানুষের দৃষ্টিতে দেশের আর পাঁচটা সরকারের থেকে পৃথক চরিত্রের করে তুলতে সক্ষম করে তুলেছিল। গণদেবতার চেতনায় স্পষ্ট হয়েছিল বিকল্প নীতির চিত্র। উদার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, নারীর মর্যাদা, নৈরাজ্য মুক্ত শিক্ষাঙ্গন, সর্বক্ষেত্রে গণতন্ত্রের পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, বিরোধী মত সম্পর্কে সহিষ্ণুতা, মর্যাদা প্রদান এসব বৈশিষ্টই বামফ্রন্ট সরকারকে দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে স্থায়ী জায়গা দিয়েছিল যাকে ফাঁপা ক্ষমতার দম্ভে সাময়িক নস্যাৎ করা হয়তো যায় কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। বরং রাজ্যের এই গৌরবজ্জ্বল অতীত ও ঐতিহ্য কে তীলেতীলে ধ্বংস করার মূলচক্রী হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আঁধার বিলাসী দলেরই শেষ পর্যন্ত স্থান হবে অন্ধকার ইতিহাসেরই আস্তাকুড়ে। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারের মূল্য মানুষ বুঝে নেবেনই আজ নয়তো কাল। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে আরো হবে ভারতীয় গণতন্ত্রের সুদূরপ্রসারী বিপদ দিল্লীর বর্তমান সরকার বা হিংস্র স্বৈরাচারী ধ্বংসাত্মক রাজ্যের তৃণমূল সরকারের কলঙ্কিত অধ্যায়ের সঙ্গে কোনো তুলনাই চলে না এই রাজ্যের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে। তবে এই সময়ে চলার পথের বাঁকে মোড়ে আমাদের মনে রাখা বোধহয় খুব জরুরী শ্রদ্ধেয় নেতা বিমান বসুর খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কথাগুলি,“ রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাধ্য বাধকতায় কখনো কখনো কমিউনিষ্ট ও বামপন্থীদের নিরবচ্ছিন্নভাবে কঠিন-কঠোর পরিশ্রমসাধ্য কাজে যুক্ত হতে হয় এবং সব গরিবের ঐক্য গড়ে তোলাকে ধ্রুবতারা হিসাবে বিচার করতে হয়। এক-দু’বার জনগণের জ্বলন্ত সমস্যা সমাধানের আন্দোলনে যুক্ত থেকে ক্লান্ত হলে চলে না, ধারাবাহিকভাবে একাজ করার জন্য অনেক শ্রম ও সময় দিতে হবে। আমাদের সকলের শ্রেষ্ঠ শ্রম এবং সময় দিয়েই আন্দোলন- সংগ্রামের উত্তাল তরঙ্গ তৈরী করার লক্ষ্যেই পথ চলতে হবে। ”( শারদ সংখ্যা গণশক্তি ’১৫, পৃ- ১০)। এবং এই চলার পথকে আত্মবিশ্বাসের শক্ত জমির ওপর থিতু করার জন্যেই আমাদের মনে রাখতে হবে দীর্ঘ সংগ্রামের শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত বামফ্রন্ট সরকারে ৩৪ বছর আমাদের অন্যতম দিক নির্দেশক। যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজকের দিনে, ২১ শে জুন।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।