চিন্তন নিউজ:৩১শে মে :- বাংলা শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যের অতীত না জানলে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবো কি করে? শিকড়ের সন্ধানে তাই বারে বারেই যেতে হয়। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো গিরীন চক্রবর্তীর নাম শোনেনি। একালের শ্রোতা পাঠকের সাথে গিরীন চক্রবর্তীর সামান্য পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
কালের নিয়মে বহু গুণী মানুষের শতবর্ষ পেরিয়ে যায় আমাদের অজান্তেই। গিরীন চক্রবর্তীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই শিশির মঞ্চে শতবর্ষ উদযাপনের একটি অনুষ্ঠান হয়। এ ছাড়াও হয়তো এক দুটো অনুষ্ঠান হয়ে থাকতে পারে। দুই বাংলায় যে ভাবে উদযাপন হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি।
৫ ই মে ১৯১৮ সালে বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে জন্মগ্রহণ করেন গিরীন চক্রবর্তী। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে এই উপমহাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উল্লেখযোগ্য। এই জেলার সঙ্গীতসাধকদের অন্যতম হলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলি খাঁ, ওস্তাদ আলি আকবর খাঁ, মহর্ষি মনমোহন দত্ত, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ প্রমুখ। এই সুরসাধকদের সমৃদ্ধ মাটি ও তিতাসের জল হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন গিরীন চক্রবর্তী। সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও ওস্তাদ আফতাবউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি লোকসঙ্গীতের প্রতি ছিল তার প্রবল টান।
অজস্র গানের তিনি রচয়িতা এবং সুরারোপ করেছেন। এর মধ্যে লোকগীতি, শ্যামাসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, আধুনিক গান সহ বহু চলচ্চিত্রের গান রয়েছে। গান রচনা করেছেন, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন কখনও স্বনামে আবার কখনও ছদ্মনামে। সুজন মাঝি, রতন মাঝি, দ্বিজ মহেন্দ্র হলো তাঁর ছদ্ম নাম। আবার ইসলামি গানের ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন সোনা মিঞা।দুঃখের বিষয় হলো তাঁর এই অসংখ্য গানের কোনও সংকলন নেই। ঢাকা বেতারে কাজ করেন কিছুদিন। এর পরে কলকাতায় চলে আসেন এবং আকাশবাণী কলকাতায় যুক্ত থাকাকালীন চালু করেন পল্লীগীতির আসর।জসীমউদ্দিন যেমন ছিলেন পল্লীকবি, গিরীন চক্রবর্তী ছিলেন পল্লীগীতির গুরু।
এইচ এম ভি- তে ট্রেনার হিসাবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। এই সময়েই তিনি খ্যাতির শিখরে পৌঁছান। এই সময়ে তাঁর কাছে তালিম নিয়ে যে সকল শিল্পীরা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁরা হলেন আব্বাসউদ্দীন, চিত্ত রায়, ভবানীচরণ দাস, চিন্ময় লাহিড়ী, আঙুরবালা দেবী, ইন্দুমতী দেবী, কমলা ঝরিয়া, শৈল দেবী, হরিমতি দেবী, রাধারাণী দেবী, যূথিকা রায়, শচীন দেববর্মন, তালাত মামুদ, অসিতবরণ, সত্য চৌধুরী, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, বাঁশরী লাহিড়ী, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। বলা যায় তালাত মামুদকে আবিষ্কার করেন গিরীন চক্রবর্তী।
গিরীন চক্রবর্তী রচিত লোকগীতি গেয়েছেন আব্বাসউদ্দীন, অমর পাল, বিষ্ণুপদ দাস প্রমুখ। এ কথা সকলেরই জানা যে ‘আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে’ গানটির প্রথম চারটি লাইন সংগৃহীত হলেও পরের লাইনগুলি লেখেন তিনি। লিখেছেন ‘নাও ছাড়াইয়া দে পাল উড়াইয়া দে’-র মতো কালজয়ী গান। দুটি গানই আব্বাসউদ্দীনের গলায় অসম্ভব জনপ্রিয়। দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে তাঁর রচিত- ‘কিশোরগঞ্জে মাসির বাড়ি/ মামার বাড়ি চাতলপাড়/ বাপের বাড়ি বামনবাইড়া/ নিজের বাড়ি নাই আমার।’ এবং ‘শিয়ালদহ গোয়ালন্দ আজও আছে ভাই/ আমি যাব আমার বাড়ি সোজা রাস্তা নাই।’ পাঠককে অনুরোধ করবো গানদুটি শুনে দেখতে। ইউ টিউবে পাওয়া যায়। গানদুটির আবেদন সে সময়ে মানুষকে চমকে দিয়েছিল।
এবার আসি কাজী নজরুল ইসলাম ও গিরীন চক্রবর্তীর সম্পর্ক প্রসঙ্গে। গিরীন চক্রবর্তী ছিলেন কাজী সাহেবের বন্ধু – সহকারী। একেবারে ছোট ভাইয়ের মতো। গিরীন চক্রবর্তীর ঢাকার পৈতৃক বাড়িতে কাজী সাহেব অনেকবার গেছেন। কাজী সাহেবের পরিবারের সদস্যরাও গিরীনবাবুকে নিজেদের পরিবারের একজন বলে মনে করতেন। কাজী সাহেবের লেখা অন্তত ২৪ টি গানে সুরারোপ করেছেন গিরীন চক্রবর্তী। ‘এই শিকল পরা ছল’ গানটিতে গিরীনবাবুর সুর স্বয়ং নজরুলকেও বিস্মিত করে। ‘কারার ওই লৌহকপাট ‘ গানটির প্রথম গ্রামাফোন রেকর্ড হয় গিরীনবাবুর গলায়। ‘বিদ্রোহী’ ও ‘নারী’ কবিতা দুটির অংশবিশেষ সুর করে নিজের গলায় রেকর্ড করেন গিরীনবাবু। কাজী নজরুল ইসলাম, গিরীন চক্রবর্তী ও আব্বাসউদ্দীন, এই ত্রয়ীর এক অদ্ভুত সম্পর্ক ছিল।
এই অসম্ভব গুণী মানুষটি বড় অকালে প্রয়াত হন। ১৯৬৫ সালের ২২ ডিসেম্বর মাত্র ঊনষাট বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। এই স্বল্প জীবনকালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। সংগীত নাটক একাডেমির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি সদস্য ছিলেন। সঙ্গীতের ধারায় বহুবিস্তৃত পথে হেঁটেছেন গিরীন চক্রবর্তী। তাঁর সেই বহুবিধ যাত্রার উপযুক্ত গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
সূত্র :
১) বঙ্গদর্পণ, ২৫ জুলাই ২০১৮ সংখ্যা
২) বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
৩) ‘খবর সাতদিন’ ওয়েব পত্রিকা
৪) রাজেশ দত্তের (চন্দননগর) একটি লেখা