কলমের খোঁচা

অগ্নিযুগের বিপ্লবী কমিউনিস্ট গণেশ ঘোষ


গৌরী সেনগুপ্ত : চিন্তন নিউজ: ২২শে জুন:– একনাগাড়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের তথা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকায় এক গর্বের ইতিহাস হ’ল বিপ্লবী নেতা গণেশ ঘোষ ।
সুদীর্ঘ ৯২ বছরের জীবনে ৭৫ বছরের সংগ্রামী জীবন , যে জীবনের দীর্ঘ ২৯ বছর কারাগারে এবং আন্দামান দ্বীপান্তরে , সশস্ত্র সং ঘর্ষে মৃত্যুর মুখোমুখি এই সাহসী যুবা । কেবলমাত্র পরাধীন ভারতকে স্বাধীন সূর্যের রক্তিম আভায় দাঁড় করাতে এই পদাতিক বিপ্লবীর সুদীর্ঘ সংগ্রাম ।
বাবা বিপিনচন্দ্র ঘোষ ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার । দুই ভাই একজন কার্তিক ঘোষ অপরজন গণেশ ঘোষ। গনেশ ঘোষ বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন ১৯১৯ সালে যখন তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র । সহপাঠী অনন্ত সিং তাঁকে মাস্টারদা সূর্য সেনের কাছে নিয়ে যান । এরপরের ঘটনা তিনি অনন্ত সিং-এর সাথে সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হন ; ১৯২১ এ অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর এই সাংগঠনিক ক্ষমতার বিস্ময়কর প্রকাশ পায় । এর মধ্যে তিনি ছাত্রদের শিক্ষার ক্লাবে ভর্তি হয়ে লাঠি ও তলোয়ার খেলায় দক্ষতা দেখান ।

১৯২২ সালে গণেশ ঘোষ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ( বর্তমান যাদবপুর ) ভর্তি হন । ১৯২৩ সালে মানিকতলা বোমা মামলায় ধরা পড়েন, বিচারে তিনি মুক্তি পেলেও প্রতিশোধপরায়ণ ইংরেজ সরকার বিপ্লবীদের কার্যকলাপ বন্ধের জন্য বেশ কয়েকজন প্রথমসারির বিপ্লবীদের আটক করে যার মধ্যে গণেশ ঘোষ ছিলেন , সালটা ১৯২৪ ঠিক সেই সময় বন্দি ছিলেন মাস্টারদা , অম্বিকা চক্রবর্তীর মতো সুযোগ্য নেতা । এঁদের সঙ্গে তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ এবং দায়িত্ব সম্পর্কে চিন্তা বিনিময় হ’ত । ১৯২৮ সালে এঁরা মুক্তি পান এবং সঙ্গে কর্মপন্থা ঠিক হয়ে যায় । মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শাখা গঠন হয় অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ , অনন্ত সিং , নির্মল সেন, লোকনাথ বল । শুরু হয় যুব-অভ্যত্থান ।.

১৯২৮ এ কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে বিপ্লবী দল সমবেত হয় , এদের সাথে চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা ছিলেন । খাঁকি খদ্দরের সামরিক পোশাকে সামরিক শৃঙ্খলায় দল গঠনের কাজ চালালেন , এই অশিবেশনের পর চট্টগ্রামে এক সামরিক শৃঙ্খলায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয় যার জি ও সি ছিলেন গণেশ ঘোষ । এই হল ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মি —চট্টগ্রাম শাখা ।যা মানুষের আস্থা অর্জন করল । গণেশ ঘোষের বাড়িতে এই সংগঠনের কাজ পরিচালিত হত । অস্ত্র সংগ্রহ, বোমা তৈরি, অর্থ সংগ্রহ, গাড়ি সংগ্রহ ইত্যাদি সংগঠনের দায়িত্বপূর্ণ কাজ গোপনে চলত, এর মধ্যে ১৯২৯এ লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় কংগ্রেসের অধিবেশন—দাবী পূর্ণ স্বাধীনতা, এই সময় গান্ধীজীর নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহ বা অহিংস আন্দোলন শুরু হয় । কিন্তু ব্রিটিশ সরকার চরম হিংস্রতায় আন্দোলন দমন করতে থাকে ।
এই সাম্রাজ্যবাদী হিংস্রতার জবাব দেয় চট্টগ্রাম ব্রিগেডের ৩৪ জন সৈনিক, আক্রমণ করা হয় সরকারী অস্ত্রাগার ও রিজার্ভ পুলিশ ব্যারাক ; নেতৃত্বে ছিলেন গণেশ ঘোষ এবং অনন্ত সিং । এই সঙ্গে রেলওয়ে অস্ত্রাগার আক্রমণ, টেলিগ্রাম, টেলিফোন অফিসের লাইন উৎপাটন, টেলিগ্রামের তার কেটে জেলাকে বিচ্ছিন্ন করা ইত্যাদির সাথে ইস্তাহার বিলি , ছাত্র-যুবদের সংগ্রামে আহ্বান করা , নাগরিকদের সমর্থন ইত্যাদি চলতে থাকে । অস্ত্রাগারগুলি দখল হয় রিপাবলিকান আর্মির সভাপতি সূর্য সেন ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করেন ; কমান্ডার গণেশ ঘোষের নির্দেশে বন্দুক থেকে শূন্যে গুলি চালিয়ে অভিবাদন জানানো হয়, সঙ্গে বিউগল ধ্বনিতে জয় ঘোষণা হয় ।

এরপর গণেশ ঘোষ সহ ৪জন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে কলকাতায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে ৫৫ মাইল দূরে ফেনী রেল স্টেশনে পুলিশ তাদের ধরে ফেলে , পুলিশ তাদের দেহ তল্লাশির চেষ্টা করে কিন্তু কোনক্রমে তারা পুলিশের কবল থেকে বেরিয়ে কলকাতায় এসে উপস্থিত হন সেখানে যুগান্তর দলের নেতারা তাদের সাহায্য করেন, ভূপেন দত্ত তাদের আশ্রয় দেন চন্দননগরে । কিন্তু চরের সূত্রে খবর পেয়ে কুখ্যাত টেগার্ট মধ্য রাত্রে তাদের বাড়ি ঘেরাও করে এবং গণেশ ঘোষ সহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে কলকাতায় নিয়ে আসে । গণেশ ঘোষকে কলকাতা থেকে নিয়ে এসে চট্টগ্রাম জেলে আটক করে এবং রাজদ্রোহী হিসেবে প্রথম ট্রাইব্যুনাল মামলায় অভিযুক্ত করে । জেলে থাকাকালীন গণেশ ঘোষরা ডিনামাইট দিয়ে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দিদের মুক্ত করার চেষ্টা করেন । কিন্তু পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় ফের ডিনামাইট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হন । প্রথম ট্রাইব্যুনাল মামলায় গণেশ ঘোষ সহ অন্য কয়েকজনের ২৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও দ্বীপান্তরের দন্ডাদেশ হয় । বিচারাধীন থাকাকালীন জেলে তিনি সাহিত্যচর্চা করতেন । তাঁর লেখা অনেক ইংরেজী ও বাংলা কবিতা সংগ্রহ করা হয়েছে ।

১৯৩২ সালের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় অনেকের সঙ্গে তাঁকেও আন্দামান সেলুলার জেলে চালান করা হয় । ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান এবং তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন । স্বাধীন ভারতেও তিনি কয়েকবার কারাবাসে ছিলেন ১৯৬২ সালে চীন ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় তাঁকে দমদম জেলে আটক করে রাখা হয়েছিল । গোটা জীবনই তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস । ১৯৫২ সাল থেকে তিনি তিনবার বিধানসভার সদস্য হয়েছিলেন । ১৯৬৭ সালে তিনি লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন সি পি আই (এম) প্রার্থী হিসেবে । ৭০এর দশকে সন্ত্রাসের সময় তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ । রাজনৈতিক জীবন থেকে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন শৃঙ্খলাপরায়ণ । কমরেড মুজফফর আহমদের সঙ্গে তিনি কিছুদিন কমিউনে বাস করেছেন । ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যদু ভট্টাচার্য লেনে ছোট্ট একটা ঘরে বাস করতেন । অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনে তিনি নিজের কাপড়চোপড় নিজে কাচতেন । বাসে বা ট্রামে চলাচল করতেন । তাঁর ভাষা ছিল নম্র এবং ব্যবহার ছিল মধুর । পার্টির রাজনীতি করতে গিয়ে তিনি পার্টিকেই দেখেছেন , পার্টিকেই ভালোবেসেছেন ।

তাঁর লেখা ‘ ‘’’মুক্তিতীর্থ আন্দামান’ বইতে তিনি স্বাধীনতার অর্থ তুলে ধরেছেন —-“——–বামপন্থী জাতীয়তাবাদ কিংবা সশস্ত্র বিপ্লব পন্থা জাতিকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করতে পারে ; কিন্তু দেশের ব্যাপকতম জনসাধারণকে সর্বাঙ্গীণ মুক্তি দিতে পারে না । দুর্দশা থেকে কিছুতেই অব্যাহতি দিতে পারে না । এই অব্যাহতি লাভ সুনিশ্চিতভাবে সম্ভব কেবলমাত্র শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে একটি দেশের খেটে খাওয়া মানুষের অর্থাৎ শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্তের সংগঠিত সফল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা । “


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।