কলমের খোঁচা

মার্ক্সীয় দৃষ্টিতে রাজা রামমোহন রায়।


চিন্তন নিউজ,  প্রতিবেদনে কল্পনা গুপ্ত, ২২ মে –  ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়কে বলা হয় ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ।  এক সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে হুগলির রাধানগর গ্রামে ১৭৭২ সালের ২২ মে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণব, তাঁর তিনজন স্ত্রীর মধ্যে মধ্যমা স্ত্রী তারিণী দেবীর সন্তান রামমোহন।  মা ছিলেন সম্পূর্ণভাবে শাক্ত পরিবারের মেয়ে। রামমোহন অতি কম বয়সে পাটনায় যান পড়াশোনার জন্য,  বিশেষত আরবী, ফারসি ভাষায় তিনি পারদর্শী হন এবং দাদুর প্রভাবে তিনি সংস্কৃত ভাষাতেও বিশেষ শিক্ষিত হন। ২৪ বছর বয়েসে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করেন।

১৮০৪ সালে একেশ্বরবাদ নিয়ে আরবি ফারসি ভাষায় বই লেখেন – তুহফাত- উল- মুয়েহহিদিন নামে।  এইসময়ে তিনি সুফি সাধনায়ও আকৃষ্ট হন।  তিনি হিন্দু, খৃষ্ট, ইসলাম এই তিন ধর্মেরই মূল সত্যকে অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের আচার ও পৌত্তলিকতা নিয়ে তাঁর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বাবা মায়ের সাথে তীব্র বিরোধ বাধে ও তিনি ত্যাজ্যপুত্র হয়ে ১৮১৫ সালে কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন। সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই চলে তাঁর।  প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সহযোগিতায় ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মসমাজ যা এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনে ভারতের নবজাগরণের পথ দেখিয়েছিলো। তাঁর যুক্তিবাদী মন ও সার্বজনীনতা, সহনশীলতা ও সমন্বয়ের ক্ষমতা তাঁকে আধুনিক মানুষ রূপে চিহ্নিত করেছে।

  ভারতে সংবাদপত্রের  স্বাধীনতার জন্য প্রথম কন্ঠস্বরটি ছিলো তাঁর। তিনি ইংরাজের ধর্মান্তরিতকরণ নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন ব্রাহ্মণীকাল পত্রিকায় তিনি তাঁর প্রকাশিত সংবাদ কৌমুদিতে তুলে ধরতেন কিভাবে বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তের বিপ্লব মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে  যে বৈপ্লবিক কাজটির জন্য সারা ভারতের নারীসমাজকে বিপন্ন অস্তিত্বের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তা হলো  ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিংক এর দ্বারা সতীদাহ প্রথা রদ। এই কাজের জন্য তাঁকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিলো। ১৮৩০ সালে ব্রিটেনে যান তৎকালীন বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের দূত হিসাবে রাজা উপাধি নিয়ে। সেখানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তিনি জোরালো ভাষায় ভারতের সুশাসনের জন্য এবং ভারতীয় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষার আলো আলোকিত করার দাবি জানান।

১৮৩৩ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর তিনি মেনেঞ্জাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ব্রিটেনের ব্রিস্টলেতে মারা যান। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন যে মুক্ত চিন্তা চেতনার আলো জ্বেলে দিয়ে গেছেন সেই আলোতেই ভারতে নব জাগরণের পথটি সুগম হয়েছিলো। রামমোহনের জন্ম ও মৃত্যু উভয়ই ঘটেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে। যখন দু’ দুটো জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো তাদের। প্রথমটি জাতীয়  বুর্জোয়া শ্রেণির  নেতৃত্বে জনগনের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ আর দ্বিতীয়টি ওয়াহাবী দলের ও ফারাজী দলের নেতৃত্বে  জাতীয় যুদ্ধ।  রামমোহনের বিভিন্ন ধরণের কাজকর্ম ছিলো এই রকম অবস্থায় কোম্পানির শাসনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

এই স্বল্প পরিসরে লেখার সুযোগ কম থাকলেও একথা বলা দরকার ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের  মধ্য দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির  ভারত দখলের সাফল্য থেকে শুরু করে রামমোহন রায়ের জীবনকালের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সময়ের মূল্যায়ন  মার্কসবাদী দৃষ্টি ভঙ্গিতে  বিচার করলে তা হবে বস্তনিষ্ঠ মূল্যায়ন। ইংল্যান্ডের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হাত পেতে ছিলো ভারতের বিপুল ঐশ্বর্য এর দ্বারে। সেখান থেকে কৃষি, খনিজ ইত্যাদির অবাধ লুন্ঠনে ক্রমশ ধনী ও উন্নত হয়ে ওঠা ব্রিটিশের আধিপত্য কয়েকশো বছর ধরে ভারতের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস  করে দিয়েছে। এই সমস্ত কিছুর মার্ক্সীয় ব্যাখ্যাই সেই সময়ের জননেতা, সমাজ সংস্কারকদের কাজের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবে।



মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।