চৈতালি নন্দী: চিন্তন নিউজ:১০ই জুন:- একসময় প্লেগের সংক্রমণ ঘটানোর সন্দেহে জার্মানিতে ইহুদীদের বেঁধে মারা হোতো। ৭০০ বছর পরেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই উত্তর দিল্লির একটি গ্রামে। এখানে ইহুদীদের পরিবর্তে মুসলিমরা আর অত্যাচারীর ভূমিকায় হিন্দু সম্প্রদায়। ঠিক এখন ভারতের লড়াই শুধুমাত্র কোভিড ১৯ এর বিরুদ্ধে নয়, এই লড়াই একযোগে করতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও। এখন আমাদের রাজনীতি আবর্তিত হয় ধর্মীয় বিদ্বেষ, এককথায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, যা ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের মদতপুষ্ট।
এবছর মার্চমাসে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরুর প্রাক্কালে এই সমস্যাটিকে বৈজ্ঞানিক ভাবে গ্রহণ না করে একে বর্ণবিদ্বেষ (রেসিজম) এর প্রেক্ষিতে গ্রহন করা হয়েছে। ঘটনাক্রমে যেহেতু এই ভাইরাসের উৎসস্থল চীন, তাই একে চীনা ভাইরাস হিসেবে দাগিয়ে দিয়ে প্রচার চালানো হয়। ফলে সেসময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপমান ও বৈষম্যের শিকার হতে হয় চীনা বংশোদ্ভূত, নেপালী ও উত্তর পূর্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে। কিন্তু এরপর রোগের বিস্তার যত বাড়তে থাকে, ততোই এই অতিমারীর সাম্প্রদায়িকীকরণ হতে শুরু করে।
দেশের গণমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমগুলোর উদ্যোগে ২১ শে মার্চের একটি ‘ইসলামিক সমাবেশকে’ ইস্যু করে তার সব দায় তবলিগী জামাতের সমাবেশের উপর চাপানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়, যেহেতু এই সমাবেশে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে যোগদান করেছিলেন ধর্মপ্রচারক ও উলেমারা। সেই সময়ও সরকার যথেষ্ট সতর্ক ও সচেতন ছিল না। এমনকি ঐ সময় অন্যধর্মের সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও সরকারি মদতপুষ্ট মিডিয়াগুলি শুধুমাত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধেই প্রচার করতে থাকে। এই প্রচারের অভিমুখ কৌশলে এমনভাবে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়, যে শুধুমাত্র মুসলিমরাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে দিয়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস করতে চাইছে এমন ধারণা তৈরীর চেষ্টা করা হয়। একইসঙ্গে বিদ্বেষ বাড়াতে ছড়াতে থাকে বিকৃত ভিডিও, ভূল তথ্য, ফটো ও মিম। এর সঙ্গেই চলে মুসলিমদের অস্পৃশ্য ও বর্জন করার চক্রান্ত যেমন, চাকরী ছাঁটাই, গণপ্রহার ও বিভিন্ন ধরনণের অত্যাচার।সময়বিশেষে যা পৌছে যায় দাঙ্গার পর্যায়ে। মিডিয়া এখানে শাসকশ্রেণীর তল্পিবাহকের কাজ করতে থাকে।
যেহেতু বর্তমান শাসকশ্রেণী হিন্দুত্ববাদের আদর্শে বিশ্বাসী, সেহেতু তাদের চিরশত্রু মুসলিমরাই। এটি সাভারকর বর্ণিত হিন্দুত্বের, যা মুসলিমদের ভারতের অংশ হিসেবে মান্যতা দিতে অস্বীকার করে তাই নয়,শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। করোনা ভাইরাস এভাবেই হিন্দুত্ববাদী শাসকদের হাতে তুলে দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো অমোঘ অস্ত্র। এই ঘটনা শুধুমাত্র ভারতেই নয়, বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘু বিভাজনের পথ প্রশস্ত করেছে। যেমন ইটালির দক্ষিণপন্থী লিগ পার্টি ঐদেশে শরণার্থীদের সরাসরি সংক্রমণের জন্যে দায়ী করছে। একই ঘটনা ঘটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন, হাঙ্গেরি, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন দেশে।
বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদী কাঠামোর ত্রুটিগুলো যতো প্রকট হচ্ছে, ততোই ব্যাপকভাবে বাড়ছে আর্থসামাজিক বৈষম্য, সরকারি পরিকল্পনাহীনতা, জনস্বাস্থ্য কাঠামোর দূর্বলতা যা সাধারণ মানুষ কে ঠেলে দিচ্ছে এক অন্তহীন নিরাপত্তাহীনতার দিকে। সরকারের সংকট মোকাবিলার ব্যার্থতার ফলে তৈরী হয়েছে, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর দূর্বলতা, পরিযাযী শ্রমিকদের দূর্দশা সহ ব্যাপক অব্যবস্থা। এই সার্বিক ব্যর্থতার দায় যদি সংখ্যালঘুদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া যায়, তবে জোরালো হবে হিন্দুত্বের ভাষ্য। ফ্যাসিবাদের ধ্রুপদী ভাষ্যে একটি কাল্পনিক শত্রু দরকার, যা সংখ্যালঘুদের উপর যে কোনো ঘৃণা, অত্যাচারকে মান্যতা দেয়। এর শিকড় এতো গভীরে প্রোথিত যাকে নির্মূল করা বর্তমানে খুবই কঠিন,কিন্তু অসম্ভব নয় । বর্তমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে যা অবশ্যম্ভাবী।