কলমের খোঁচা

স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন ও প্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদের ভাবনা নির্যাস।


কল্পনা গুপ্ত, নিউজ চিন্তন:৪ঠা জুলাই:- – স্বামী বিবেকানন্দের ১১৮তম প্রয়াণ দিবসে তাঁর দর্শন ও প্রাসঙ্গিকতার আলোচনার মধ্য দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রয়াসে এই নিবন্ধ। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে বিবেকানন্দকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চিত্রায়িত করছে তাতে বিবেকানন্দের ভ্রান্ত মূল্যায়ন হচ্ছে।
কালিকট বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত বিভাগের উদ্যোগে একটি সেমিনারে ‘আজকের দিনে বিবেকানন্দের দর্শন ও প্রাসঙ্গিকতা’ বিষয়েই এম এস নামবুদ্রিপাদ যে আলোচনা করেছিলেন তারই সূত্র ধরে বলা যায় যে তাঁর মতে স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের অন্যতম নেতা। তাঁর মতে কোন দার্শনিকের কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করতে গেলে সেই সময়ে তিনি যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে জীবিত ছিলেন ও কাজ করেছিলেন সে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দুই প্রাচীন দার্শনিক বুদ্ধ ও শংকরের সঙ্গে বিবেকানন্দের কাজের ব্যাপ্তির বিষয়ে বলেন। বুদ্ধের বিষয়ে তাঁর অভিমত- পুরানো ট্রাইব্যাল সমাজের ভাঙ্গন এবং জাত-পাতভিত্তিক সমাজের আত্মপ্রকাশের সন্ধিক্ষণে বুদ্ধের আবির্ভাব। সেখানে তিনি নতুন সমাজের ওপর তলার মানুষ হয়েও জাতপাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মানুষ। বৈদিক ব্রাহ্মণ সমাজের অধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদ বিরোধী এবং বস্তুবাদ ও নাস্তিকতার জন্য তাঁর প্রতিপক্ষরা তাঁকে ও তাঁর দর্শনকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

বৌদ্ধ দর্শনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সামনের সারিতে এলেন শংকরাচার্য। বুদ্ধ যেমন একজন দার্শনিক হিসাবে মরণোন্মুখ সমাজকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন তেমনি শংকর ছিলেন উদীয়মান জাতপাত ব্যবস্থার দার্শনিক। কিন্তু পরে সামাজিক বিবর্তন ও বহিশক্তির প্রবেশ ঘটা ইত্যাদিতে শংকরের জাতপাত ব্যবস্থাও নতুন শক্তির কাছে এঁটে উঠতে পারেনি। উন্নত ভারতীয় সংস্কৃতি এই উগ্র জাতপাত ব্যবস্থায় পড়ে নিপীড়িত জনগনের হীনবলতার কারণে ইউরোপীয় নতুন শক্তি শিক্ষা, সংস্কৃতির কাছে পরাস্ত হয়ে পিছিয়ে পড়তে থাকে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতেও যে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও আবিষ্কার হয়েছিলো, শংকরের উগ্র জাতপাত দর্শনের ফলে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে।

এই সামাজিক, অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার অভিজ্ঞতা থেকে প্রথমে বাংলা ও পরে সারা দেশে এক নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটে। এই নতুন বুদ্ধিজীবীদের বৈশিষ্ট্য ছিলো যে তাঁরা শংকর প্রবর্তিত জাতপাত সমাজের সুচিন্তিত বিরোধিতা ও আক্রমন শুরু করেন। নবজাগরণের প্রবক্তারা চেষ্টা করেছিলেন এক নব সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আর্থ- সামাজিক উত্থান ঘটাতে।

স্বামী বিবেকানন্দ সেই দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী যিনি দেশের প্রতিটি কোনে৷ গিয়ে চোখে দেখে শুধু তার ব্যাখ্যাই করেননি পরিবর্তনেত চেষ্টাও করেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন এক আধুনিক, বিজ্ঞান কেন্দ্রিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, রাজনৈতিক ভারত গড়ে তুলতে। তিনি ‘শূদ্র শাসনের’ কথা বলেছিলেন যা কিনা সর্বহারা শাসনের কথা বলে। তিনি এক সার্বিক সাম্যের আহবান দিয়েছিলেন।

অধ্যাপক হীরেন মুখার্জির মতে- Vivekananda knew as Marx did, that men can not make history as they please, but in builbing the future they have to use bricks left by the past.’ তাঁর মতে প্রকৃতপক্ষে ‘it is totally unfair to lebel Vivekananda’s work as religious nationalism. ‘ যে ধারণা বিবেকানন্দ জাতীয়তাবাদীদের দিয়েছিলেন তা হল ভারতীয় আইডেন্টিটি(Identity) এবং আধুনিকতার মধ্যে সাযুজ্য স্থাপন।

বিবেকানন্দ বরাবর বলেছেন, ‘ আমরা এখন কেবল ছুঁৎমার্গী, আমাদের ধর্ম এখন রান্নাঘরে। ‘ উনিশ শতকের শেষে ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে জাতপাতের বিরুদ্ধে এইভাবে যুদ্ধ ঘোষণার উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায়।

মার্কসবাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় না হলেও তাঁকে একজন গণতান্ত্রিক, সমাজবিদ্রোহী বলা যায় এবং ভারতীয় সমাজের সম্পূর্ণ পূনর্গঠনের কাজ করে গিয়েছিলেন।

তারই ফলে পরবর্তীকালে মার্কসবাদের উপর ভিত্তি করে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন ও বিপ্লবী সমাজের আন্দোলন গড়ে ওঠে। সুতরাং তাঁর বিপ্লবী শিক্ষাই আজও প্রাসঙ্গিক ভাবে বিরাজমান।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।