চৈতালি নন্দী: চিন্তন নিউজ:১৮ই জুন:- ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সত্যিই যদি বাঙালির নায়ক নেতৃত্ব হতেন, তবে এতো দ্রুত তিনি মানুষের বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতেন না। বাঙলিরা যেমন ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামী বাঙালি নেতা হিসেবে সুভাষ চন্দ্র বোস, চিত্তরঞ্জন দাস, বা রাসবিহারী বসুকে হৃদয়ে জননেতার স্থান দিয়েছে, শ্যামাপ্রসাদ তা থেকে বঞ্চিত হলেন কেন? কেনই বা এঁদের সঙ্গে একসাথে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়না!
শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবন ছিল স্বল্প মেয়াদী।একাধারে তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী ও আইনজ্ঞ। কিন্তু স্বভাবে ছিলেন অস্থিরমতি ও চঞ্চল চিত্ত। প্রথমে কংগ্রেস ও গান্ধী, এরপর নির্দল তারপর আবার কংগ্রেস, কৃষকপ্রজা পার্টি ও মুসলিম লিগ, তারপর নির্দল ও শেষে হিন্দু মহাসভার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গিয়ে পৌঁছান ভারতীয় জনসঙ্ঘে। তাঁর এই হঠকারী, অস্থির রাজনৈতিক বদল তাকে বাঙালির নিজের লোক হতে দেয়নি। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাশাপাশি বাহ্যিক আবরণে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও সম্প্রদায়িকতার মোড়কে ধর্মের চোরা স্রোত যা আপাতভাবে দৃশ্যমান না থাকলেও, তিনি তাঁর চর্চা করে গেছেন সারাজীবন। তিনি যে বিষবৃক্ষ রোপন করে গেছেন আজ তা মহীরূহ।
১৯২১-২২ এর অহসযোগ আন্দোলন, ভারতছাড়ো আন্দোলন, আজাদহিন্দ ফৌজের বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে নৌবিদ্রোহ হয়ে ৪৬ এর দেশব্যাপী ধর্মঘট যা ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিভিন্ন স্তর, তা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ব্রিটিশদের স্নেহভাজন হবার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। উল্টে এই আন্দোলন গুলির বিরোধিতা করে আন্দোলন কিভাবে স্তিমিত করা যায়, তার উপায় বাতলে দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের। এই স্বাধীনতা আন্দোলন কে উচ্ছৃঙ্খল আখ্যা দিয়ে তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। এমনকি আজাদহিন্দ বাহিনীর মরণপণ লড়াইয়ের সময়, তাকে দমন করার জন্যে ‘গৃহবাহিনী’ গঠনের অধিকার চেয়েছিলেন ব্রিটিশ দের কাছে, যা আর যাই হোক তাকে দেশপ্রমিকের মর্যাদা দেয়নি। ১৯৩৯ এর কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনের সময় তিনি সুযোগ বুঝে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
তাঁর চরিত্রের স্বচ্ছতা, দৃঢ়তা ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধের অভাব তাকে জাতীয় নেতার মর্যাদা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক আদর্শবোধ নয়, ছলে বলে কৌশলে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময়, যখন খাদ্যের জন্যে হাহাকার, তখন তিনি হুগলির জিরাটে প্রাসাদ তৈরির মতো অমানবিক কাজ করেও সমালোচিত হয়ছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশ যখন উত্তাল সেই সন্ধিক্ষণে তার বিরোধিতা করেন তিনি, যা তাকে জনগনের নেতা হতে দেয়নি। জননেতা হতে গেলে যে ত্যাগ, কৃচ্ছসাধন, মানবিকবোধ, এবং আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ থাকার কথা, তা তাঁর ছিলনা।