কলমের খোঁচা

চায়ে পে চর্চা


গৌতম রায়: চিন্তন নিউজ:২২শে আগস্ট:–আবার চায়ে পে চর্চা।
দীঘাতে জগন্নাথ মন্দির করার শিবা কীর্তন সমাধান করে রাজধানীতে ফেরার পথে রাস্তার ধারে একটি চায়ের দোকানে ঢুকে পড়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর চা তৈরি করা এবং পারিষদ বর্গ কে সেই চা বিতরণ করবার দৃশ্যাবলী সামাজিক গণমাধ্যমে দৌলতে আমরা সবাই দেখলাম ।মুখ্যমন্ত্রীর যে কেবল রাঁধেন ই না ,চুলও বাঁধেন– এমনটা আমরা তিনি বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন আটের দশকের গোড়া থেকেই শুনে আসছি ।
গণ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে একজন নেতার ইমেজ বিল্ডিং এর যে সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি স্বাধীনতার আগে বা পরে পরিচিত ছিল ,সেই পরিচয়ের রূপ রেখা বদলে দিয়ে, সমাজের একেবারে নীচুতলা থেকে উঠে আসা এই রাজনৈতিক নেত্রীকে বাংলার ভাগ্যবিধাতা হিসেবে উপস্থাপিত করবার চেষ্টা টা কেবল যে দু একজন তাঁর বশংবদ সাংবাদিক করেছেন, এমনটা ভাবলে কিন্তু খুব ভুল হবে ।
রবীন্দ্রনাথের ,”মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক”– এ কথার সার্থক নামা হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে তুলে ধরার ক্ষেত্রে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে বহু পাকা মাথার মানুষজন যে কাজ মাথা ঘামিয়েছেন, সে কথা বলবার অপেক্ষা রাখে না ।বিরোধী নেত্রী হিসেবে ও রাজনীতির বাইরে মমতার ব্যক্তি সর্বস্বতাকে অবলম্বন করে তাঁর ইমেজ গড়বার কাজটি বেশ পরিকল্পিতভাবেই হয়েছিল।
প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, ডাঃ বিধান রায় ,প্রফুল্ল চন্দ্র সেন ,সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের মত কংগ্রেসের নেতারা যখন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছিলেন ,তখন কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে ,আলাদা করে এঁদের ইমেজ তৈরীর প্রয়োজন হয়নি। রাজ্য বা জাতীয় ,এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরে সেই সব শক্তিগুলি, যাঁদের কাছে সবথেকে বড় আপত্তির বিষয়টি ছিল, ‘বামপন্থীদের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি’ তাঁরা মমতার এই ইমেজ বিল্ডিংয়ের কাজটি জোরদার ভাবে শুরু করেছিলেন।
অত্যন্ত উঁচু দরের চিকিৎসক বিধানচন্দ্রের চিকিৎসক জীবন ঘিরে নানা ধরনের কাহিনী প্রচলন আছে ।সেই সব কাহিনীর ভিতরে সত্যতাও আছে, আবার অতিভক্তির সংমিশ্রণ ও আছে। বিধান রায় কে ঘিরে এই ধরনের প্রচার পর্বে আমরা কিন্তু একবারের জন্যে ও দেখতে পাই না ,’আমি তোমাদেরই লোক হিসেবে ‘ তাঁর ইমেজ তৈরীর উদ্দেশ্যে তাঁর ব্যক্তি জীবন ঘিরে নানা ধরনের স্তুতিমূলক প্রচার ।
একই কথা বলতে হয় প্রফুল্ল চন্দ্র সেন বা প্রথম অ কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় কে ঘিরে সেই সময়ের বিভিন্ন প্রচার পর্ব কে নিয়ে। প্রফুল্ল চন্দ্র সেন কি দিয়ে ভাত খেতেন, চায়ে ক চামচ চিনি ব্যবহার করতেন , ভাতের পাতে কোন সবজি পছন্দ করতেন ,কোন মাছে কোন ফোড়ন ছিল তাঁর খুব প্রিয় –এইসব অ রাজনৈতিক প্রচার কিন্তু তাঁকে ঘিরে, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের চরম উৎকর্ষতার দিনগুলিতেও দেখতে পাওয়া যায়নি ।
রাজনৈতিক প্রফুল্ল চন্দ্র সেন কে ছাপিয়ে ,ব্যক্তি প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের একটা ইমেজ তৈরি করে, সেই ইমেজের উপর ভরসা করে তখনকার শাসক কে কিন্তু নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হয় নি ।
একই কথা প্রযোজ্য অজয় মুখোপাধ্যায় সম্পর্কেও ।তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর একাধিক সিদ্ধান্ত ঘিরে বহু বিতর্কের পরিবেশ তৈরি হলেও ,অজয় বাবুকে কিন্তু একবারের জন্যেও জনগণের সেবক হিশেবে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে দেখা যায় নি।
সিদ্ধার্থ শংকরের রাজনৈতিক জীবন যতই বিতর্কিত হোক না কেন, রাজনীতির পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে তাঁর লন্ডনের শ্বশুরবাড়ি থেকে শুরু করে তাঁর পত্নী মায়া রায়ের আধ্যাত্মিকতার মজাদার গল্প– এসব নিয়ে কিন্তু সে যুগের সংবাদমাধ্যমের মানুষজন কাগজ ,কালি, কলম ,নিউজপ্রিন্ট তেমন একটা খরচ করেননি।
জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়ে এই দিক থেকে কোনো ভাবনা চিন্তা করার প্রয়োজন এইসব প্রচারকেরা মনে করেন নি। স্বভাবতই সস্তার প্রচারের কোনোরকম পথে এঁরা কখনো হাঁটেননি ।আর সাংবাদিকরা যখন রাজনীতির বাইরে গিয়ে জীবন যাপন, পছন্দ খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি নিয়ে জ্যোতি বাবু কে প্রশ্ন করে করেছে,সেই প্রেক্ষিতে জ্যোতিবাবু কিন্তু নিজের বিরক্তি কখনো গোপন রাখেন নি ।
তাই প্রশ্ন হচ্ছে ,গত প্রায় নয় বছর ধরে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর আমজনতার লোক হয়ে উঠবার এই যে উদগ্র বাসনা, তাকে ঘিরে কেন সংবাদ মাধ্যমের এত মনসংযোগ? মমতা দীঘার সমুদ্র সৈকতে কতোক্ষন হাটলেন, তার সঙ্গে কি পশ্চিমবঙ্গের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হিংসার মোকাবিলার কোনো রকম সম্পর্ক আছে ?
মমতা কোন সভায় গিয়ে তাঁর সাপ জনিত অভিজ্ঞতার আজব বর্ণনা দিলেন, তাকে ঘিরে কি পশ্চিমবঙ্গের একটি শিক্ষিত বেকারের মুখেও এক কণা ভাতের দানা ওঠার কোন পরিপ্রেক্ষিত আছে?
হঠাৎ কনভয় থেকে নেমে হাইওয়ের পাশে চায়ের দোকানে ঢুকে গিয়ে, চা তৈরি করে ,নিজের হাতে সবাইকে খাওয়ানোর ভেতর দিয়ে কি বন্ধ হয়ে যাওয়া চা বাগানের শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুর্দশার নিরসনের বিন্দুমাত্র কোন ইঙ্গিত আছে?
তাহলে কেন আপাদমস্তক ব্যক্তিস্বার্থ বাহী, প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার উদগাতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পার্সোনাল ইমেজ বিল্ডিং এর জন্য একাংশের মিডিয়ার এতোখানি মাথাব্যথা? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে ,নিজেকে আমজনতার লোক বলে প্রমাণ করতে হাইওয়ের ধারে চায়ের দোকানে ঢুকে ,চা বানাতে থাকা মমতা ই কিন্তু ভোটের সময় ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কোনো সংঘাত না করার বার্তা ইতিমধ্যেই দিয়েছেন ।
কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে মমতার পাঠানো কুর্তা মিষ্টির খবর প্রকাশ্যে আসার পর, ভোটের সময় সাম্প্রদায়িক বিজেপি কে নিয়ে চিল চিৎকার জোড়া মমতার ভোটের পর সেই সাম্প্রদায়িক বিজেপি পরিচালিত সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার বার্তার ভেতর দিয়ে পাঠক নতুন কিছু ইঙ্গিত পাচ্ছেন?
মমতার তৈরি করা চা যাঁরা খেলেন, তাঁরা সকলেই চাতে চা পাতা ,দুধ, চিনি ইত্যাদির ভাগ সব ঠিকঠাক পেয়েছিলেন তো ?মমতা কে খুশি করতে, বেশি তাড়াতাড়ি গরম চা খেয়ে নিয়ে কারুর জিভ পুড়ে যায় নি তো? ডায়াবেটিসের রোগী, মমতার একদা গুরু সুব্রত মুখোপাধ্যায় ,যাঁর বর্তমান পরিচয় মমতা অধস্তন একজন মন্ত্রী মাত্র ,তাঁর জন্য মমতা চিনি ছাড়া চা বানিয়েছিলেন, না কোনো সুগার ফ্রী কেমিকাল সেই চাতে মিশিয়ে ছিলেন —এ তথ্যটা অবশ্য প্রচারকেরা এখনো পর্যন্ত দেননি।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।