কলমের খোঁচা

বাবরি মসজিদ ধ্বংস – একটি সাম্প্রদায়িক ক্ষত।


কল্পনা গুপ্ত:চিন্তন নিউজ: ৬ই ডিসেম্বর,২০২০:– – ভারতের উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যায় রামকোট হিলের ওপর ছিলো একটি প্রাচীন মসজিদ। এই মসজিদের নির্মান হয়েছিলো ১৫২৮ সালে বাবরের আদেশে। তাঁর সেনাপতি মীর বাকী এই মসজিদ তৈরি করেন। তবে প্রচলিত বিশ্বাস হলো যে এখানেই ছিলো হিন্দুধর্মের অবতার পুরুষ রামচন্দ্রের জন্মস্থান। অবশ্যই বিতর্কিত বিষয়, যেখানে মানুষের সবকিছু মাপা হচ্ছে তার পালিত ধর্মীয় আবেগের ওপর। তবে ২০০৩ এ ভারতীয় ভূমি জরিপ বিভাগের প্রতিবেদনে জানা যায়, মসজিদের নীচে রয়েছে এক পুরাতন স্থাপত্যের অস্তিত্ব।

১৮৮৫ তে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে বাবরি মসজিদের বাইরে চাঁদোয়া টানানোর আবেদন জানান মহান্ত রঘুবর দাস, কিন্তু তা নাকচ হয়। ১৯৪৯ তে সক্রিয় হিন্দুত্ত্ববাদীরা হিন্দু মহাসভার সাথে এক হয়ে রামের একটি মূর্তি মসজিদে রেখে এলে সাম্প্রদায়িক গোলযোগ তৈরি হয় এবং সরকার ওই স্থানটিকে বন্ধ করে দেয়। এরপরে স্থানটির দখল নিয়ে নির্মোহী আখরা, সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড মামলা করে। ১৯৮৬ তে ভোটের মুখে হিন্দু মনোরঞ্জনের উদেশ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সময়ে স্থানীয় আদালতের নির্দেশে হিন্দু তীর্থযাত্রীরা ওই স্থানে প্রবেশাধিকার পায়। কিন্তু ১৯৮৯ এ এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশ হয় বিতর্কিত স্থানের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার। ১৯৯০ এর ২৫ শে ডিসেম্বর ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি গুজরাটের সোমনাথ থেকে হিন্দুত্ব প্রচার মূলক উগ্র ও আগ্রাসী কর্মসূচি নিয়ে রথযাত্রা শুরু করেন। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এই আগ্রাসনের ফলশ্রুতিতে ঘটে যায় এক সংহতি বিনাশী, দেশের অখন্ড সাংস্কৃতিক মনীষা ধ্বংসকারী ভয়ংকর ঘটনা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং তাদের সহযোগী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের কর্মীরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয় তাদের নেতাদের সম্মতিতে এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয় থাকার সহযোগিতায়। এটা শুধু একটা স্থাপত্য ধ্বংস নয়, ধ্বংস একটি দেশের অখন্ড, অটুট মনোবলের। ভারতের সংহতির ইতিহাস কলংকিত হয় ভারতেরই বর্হিবিশ্বের কাছে।

এরপরে ইতিহাসের চাকা গড়াতে থাকে। ১৯৯৪ এ সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়- মসজিদ ইসলামের অন্তর্গত ছিলো না। ২০১৭ এর ২০ শে নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের সিয়া সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড সুপ্রিম কোর্টকে বলে- অযোধ্যায় মন্দির ও লখনৌয়ে মসজিদ বানানো যেতে পারে। এরপর ৯ই নভেম্বর ২০১৯ এ রাম জন্মভূমি মামলায় ঐতিহাসিক রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বিতর্কিত জায়গা দেওয়া হয় হিন্দুদের আর অযোধ্যাতেই ৫ একর জমি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় মুসলিমদের।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে সারাদেশে সাম্প্রদায়িকতার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রায় ২০০০ হাজারের ওপরে মানুষ নিহত হয়েছিলো যার বেশিরভাগই মুসলমান সম্প্রদায়ের। মুম্বাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো বেশি। আর এর ফলে দেশে বিদেশি জঙ্গী শক্তি আরো তৎপর হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দেশকে এক অভাবনীয় খারাপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছিলো। ২০০৫ এর একটি গোয়েন্দা রিপোর্টে গোয়েন্দা প্রধান মলয়কৃষ্ণ ধর দাবি করেন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার দশ মাস আগেই এই পরিকল্পনা করেছিলেন।

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান, বাংলাদেশে, মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী ভারতীয়রা ও ভারতীয় বংশদ্ভূত হিন্দুরা প্রবল বিপদের মুখোমুখি হয়। পাকিস্তানে ৩০ টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে উন্মত্ত জনতা। বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির, দোকান, বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এয়ার ইন্ডিয়ার কার্যালয় দুই দেশেই আক্রান্ত হয়। দুবাই, আবুধাবিতেও সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

নিজ দেশের সহিষ্ণু সংস্কৃতির ঘাতক, সংহতি, সম্প্রীতি বিনাশকারীদের আজ আবার আমাদের চিনে নেওয়ার দিন, ধিক্কারের দিন, আমাদের অভিজ্ঞতাকে মর্যাদা দিয়ে সেদিনের ওই বিনষ্ট, ভ্রষ্ট পথপ্রদর্শকদের আসুন আবার আমরা দেশের শুভ ও সুস্থ সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করি। কবিগুরুর ভাষায় উচ্চারণ করি –
” ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে’জন মারে আর শুধু মরে।
….বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে,
নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে-“


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।