কলমের খোঁচা

ঐতিহ্যের হাওড়া স্টেশন_


সূপর্ণা রায়:চিন্তন নিউজ:১৫ই ডিসেম্বর:–ঐতিহ্যের হাওড়া স্টেশন। ১৮৫২ সালের ১৫ ই আগষ্ট, একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে ফুলে,মালায় সেজে হাওড়া নামে একটি গ্রামের পূর্ব তীরে, গঙ্গা নদীর পাড়ে।। এই ট্রেনটিতে মোট আটটি কামরা। ফার্স্ট ক্লাস তিনটি, সেকেন্ড ক্লাস দুটি আর তৃতীয় ক্লাস তিনটি।। পেছনে ছিল গার্ডের ব্রেকভ্যান।।৩০০০ জনের ভ্রমণের ব্যবস্থা থাকলেও মোট যাত্রী ছিল ৩০০ জন।। ট্রেনের চালক ছিলেন জোসুয়া গ্রিনবো।। ট্রেনের চলার সাথে সাথে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়।।এই ট্রেনের কামরা ও ইঞ্জিন আনা হয়েছিল “”এইচ এম এস”” জাহাজ এ করে।।

ট্রেন ছেড়েছিল হাওড়া থেকে কিন্তু তখন হাওড়া স্টেশন বলে কিছু ছিল না।।১ লা সেপ্টেম্বর ট্রেনের চলাচল হুগলি জেলার পান্ডুয়া পর্যন্ত প্রসারিত হয়। গড়ে উঠলো স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম। তখন কেউই ভাবেনি এই এক লাইন এর স্টেশনটি হয়ে উঠবে বিশ্বের ব্যস্ত স্টেশন।। যখন ভারতে বৃটিশরা শাসন করত তখন ভারতের রেলকোম্পানীর নাম ছিল ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলকোম্পানী। তখন ফার্স্ট ক্লাসের টিকেটের দাম ছিল ৩টাকা আর তৃতীয় শ্রেণীর টিকিটের দাম ছিল ৭ আনা।।

এরপর রানীগঞ্জ পর্যন্ত রেল লাইন পাতা হয় ১৮৫৫ সালে।। এই বছরের ৩ রা ফেব্রুয়ারি সরকারি ভাবে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের উদ্বোধন হয় বর্ধমান শহরে।। অসাধারণ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা মধ্যে সকাল ৯:৪০ মিনিট এ সুচনা হয় ঐতিহাসিক রেলযাত্রার।। লর্ড বিশপ এই যাত্রার সুচনা করেন।। ট্রেন টিকে স্বাগত জানাতে বর্ধমান জেলা শহরকে ফুলে, ব্যানারে ,আলোতে সাজানো হয়েছিল।। বর্ধমান জেলার রাজা নিজে এসে যাত্রীদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।। ট্রেনের ফেরা হয়েছিল ৩:৩০ নাগাদ এবং গন্তব্যে পৌঁছাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গিয়েছিল।।

হাওড়া স্টেশন সেদিন গ্যাস বাতিল আলোতে ঝলমল করছিল।রেল উদ্বোধন উপলক্ষে সেদিন ছিল সারা রাতের উৎসব।। খানাপিনা,বলড্যান্স আসর।।১৮৬৫ সালে ট্রেনের ছাড়া ও ধরার জন্য পৃথকভাবে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়।।১৮৮৫ সালে আরও একটি।। এই ভাবে গঙ্গা নদীর জল ব‌ইতে লাগল আর এদিকে ট্রেন , প্ল্যাটফর্ম এবং যাত্রীদের সংখ্যা তীব্র গতিতে বাড়তে লাগলো।। আজকের হাওড়া স্টেশনের সাথে অতীতের হাওড়া স্টেশনের কোন মিলই নেই।। ১৫০ বছর পেরিয়ে গেছে।। বহু পরিবর্তনের মধ্যে আজ হাওড়া স্টেশন বঙ্গজীবনের অঙ্গ।। প্রতিটি মানুষের আবেগের জায়গা এই হাওড়া স্টেশন।

এখন অনেক ধাক্কাধাক্কি পেরিয়ে যখন শুনি মাইকের ঘোষণা”””অনুগ্রহ করে শুনবেন ৪:২০ মিনিটে ৩ নং প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে””মনটা উদাস হয়ে যায়।দুরপাল্লার ট্রেনের কূ ঝিক ঝিক মিলিয়ে যায় দুর থেকে দূরে বহুদূরে।। আজকের হাওড়া স্টেশন আর শুধু মাত্র যাত্রীদের জন্য নয় এখানে ভিখারি, ফেরিওয়ালা,হকার সকলের গিজগিজে ভীড়।। যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত চেয়ার গুলো অবাঞ্ছিত লোকের ভিড়। স্টেশন চত্বরে জুড়ে বাজর, ফুলের দোকান। ঐতিহ্য পৃর্ন এই স্টেশন পানের পিক, নোংরা আবর্জনাতে ভর্তি। ব্যস্ততম বলেই কি এত অব্যবস্থাপনার কবলে প্রিয় হাওড়া স্টেশন।।

হাওড়া স্টেশন কলকাতা শহরের একটি ল্যান্ডমার্ক। মানুষের প্রতিটি পদক্ষেপে জড়িয়ে যাওয়ার এক স্মারক।।যে কোন প্রান্তিক স্টেশনের উপর সাধারণ মানুষের একটি বিশেষ আগ্রহ থাকে।। কেউ ট্রেন এ চড়েন কেউ নামেন তবু সবার একটা অদম্য টান থেকে যায়। স্টেশন এর পরিবর্তন এর সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে , হাওড়া নামের গ্রামের চেহারা।

এখন যেখানে ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্ম সেখানে ছিল হাওড়া স্টেশনের প্রথম ট্রেন লাইন ও প্ল্যাটফর্ম। এখানে ই গড়ে উঠলো হাওড়া স্টেশন বাড়ি। এখানে একটি ফলক লেখা হয়“”দ্য ফার্স্ট ট্রেন ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া ফর্ম দিস প্লেস।১৫–৮–৫৪,ফ্রম হাওড়া হুগলি। ১৯ শতকে হাওড়া স্টেশন কে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সাজিয়ে ছিল মনের মতো করে। ট্রেনের চলাচল এর হিসাব রাখতে লাগানো হয়েছিল তিনটি ঘড়ি।।তার মধ্যে উত্তরের বড়ো ঘড়িটি এখনো অবধি নিখুঁত ভাবে সময় দিয়ে চলছে।জেন্টস কোম্পানির ঘড়িটি বসানো হয় ১৯২৬ সালে। সময়ে সময় এ বহু পরিবর্তন এর সাক্ষী এই হাওড়া স্টেশন।।

দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের থাকার জন্য কতকগুলো কুঠুরি তৈরি করা হয়।।পরে ১৯৪৭সালে বাঙলা দেশের রিফিউজি রা এখানে আশ্রয় পান তাও এক দুই বছর নয় প্রায় দশ দশটি বছর তারা এখানে কাটান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২ সালে রেল কোম্পানি র নাম হল ইস্টার্ন রেলওয়ে।।এর ইলেকট্রিসি।। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উদ্বোধন করতে এসে আলোয় সাজানো স্টেশন দেখে মন্তব্য করেছিলেন _“”

এ যেন বিয়ের নহবৎ খানা”””…প্রথম ইলেকট্রিক ট্রেন চলেছিল হাওড়া থেকে শেওড়াফুলি।।মুল স্টেশন এ ১১৭ টি প্ল্যাটফর্ম।সুপারফার্সট রাজধানী এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়েছিল ১৯৬৯ সালের ৩ রা মার্চ।।এটি সর্বপ্রথম বাতানুকূল ট্রেন।। এখন দুরপাল্লা, যাত্রীবাহী, লোকাল, ট্রেনের সংখ্যা ৬৪০ ছাড়িয়ে গেছে।।১৯৯৩ সালে হাওড়া স্টেশন মডেল স্টেশনের স্বীকৃতি পায়। দক্ষিণ পূর্ব রেলের ১৭_২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে তৈরি হয় নতুন কমপ্লেক্স যা পুরোনো কমপ্লেক্সের সাদৃশ্য রেখে।।।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।