কলমের খোঁচা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

প্রসঙ্গ-বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস


প্রতিবেদন-ডাঃ স্বপ্না চট্টরাজ:চিন্তন নিউজ:- ১০ই সেপ্টেম্বর- বিশ্বজুড়ে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা, কমছে জীবনের প্রতি ভালোবাসা। আত্মহত্যা ঠেকাতে ২০০৩সাল থেকে প্রতি বছর ১০ ই সেপ্টেম্বর বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বে আট লাখের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রায় ১৫-২০গুন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে জনসচেতনতা বাড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন ( I. A. S. T) এবং ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ (W.F.M.H) এই বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করে।

গত বছর থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ( ওয়ার্কিং টুগেদার টু প্রিভেন্টিভ সুইসাইড) অর্থাৎ আত্মহত্যা প্রতিরোধে একসঙ্গে কাজ করা।
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০জন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এরমধ্যে নারী পুরুষ কিশোর কিশোরী শিশু সব বয়সের মানুষ রয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ২১-৩০বছরের নারীরা আত্মহত্যা বেশি করে থাকে। এই বয়সের পুরুষেরাও নানা কারণে আত্মহত্যা করে থাকে। করোনা মহামারী চলাকালীন মানসিক চাপ বেড়ে যাওয়ায় আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞদের মত হল বৈষম্য, বঞ্চনা, বিভ্রান্তি, হতাশা, মাদকাসক্তি, না পাওয়ার যন্ত্রনা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। যেখানে সমাজের ভারসাম্য কম, অগ্রগতির সুফল সবাই সমান ভাবে পায় না সেখানেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হয়। সাম্প্রতিক কালে করোনা মহামারী সময়ে শ্রমিকের কাজ চলে যাওয়া, কৃষকের ফসলের নায্য মূল্য না পাওয়া, বেকার যুবক যুবতীর কাজ না পাওয়া থেকে আত্মহত্যার খবর বেশি করে শুনতে পাচ্ছি। এমনকি শাসকের কঠোর মনোভাব বা প্রতিহিংসাপরায়ণ ও আত্মহত্যার কারণ হয়ে উঠছে। উদাহরণস্বরূপ চিকিৎসক অবন্তিকা ভট্টাচার্যের আত্মহত্যা, পাঁচ জন শিক্ষিকার আত্মহত্যার চেষ্টা আমাদের মনকে নাড়া দেয়।

মহারাষ্ট্রে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। তারপর রয়েছে যথাক্রমে তামিলনাড়ু পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ এবং কর্নাটক। দেশের মোট আত্মহত্যার ঘটনা ৪৯.৫শতাংশ ঘটেছে এই পাঁচ রাজ্যে।সাধারণত দুই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকে।
১-আগে থেকে পরিকল্পনা করে, আয়োজন করে, সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা, যাকে বলা হয় ডিসিসিভ সুইসাইড।
২-হঠাৎ করে আবেগের রাশ টানতে না পেরে আত্মহত্যা, যাকে বলা হয় ইম্পালসিভ সুইসাইড।
যারা ডিসিসিভ সুইসাইড করে তারা কিন্তু আগের থেকে আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। যেমন-১-তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে।
২-আত্মহত্যার বা মৃত্যু বিষয়ক গান, কবিতা লিখতে পড়তে বা শুনতে ভালবাসে। ৩-নিজের ক্ষতি করে। প্রায়ই নিজের হাত কাটেন, বেশি করে ঘুমের ওষুধ খায়।
৪-মনমরা হয়ে থাকে, কোনো কাজে উৎসাহ থাকে না, নিজেকে দোষী ভাবে-এধরনের বিষন্নতার লক্ষন আত্মহত্যা ঘটায়।
৫-সারারাত জেগে থাকা, আর সারাদিন ঘুমানো।
৬-নিজেকে গুটিয়ে রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করা।
৭-মাদকাসক্তি বা ইন্টারনেটে মাত্রারিক্ত আসক্তি আত্মহত্যায় সহায়তা করে।
৮-পড়াশোনা, খেলাধুলা, শখের বিষয় থেকে নিজেকে দূরে রাখা।
কিশোর কিশোরী দের আত্মহত্যার কারণ হলো
১-পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে
২-প্রেমে ব্যর্থ হলে
৩-অবৈধ সম্পর্কের জন্য
৪-স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়তি চাপ, রিগিং এ দিশেহারা হয়ে।
৫-বেকার সমস্যায় হতাশ হয়ে।
৬-ক্ষতিকারক নেশা যেমন ড্রাগসের প্রভাবে।
৭-সাম্প্রতিক কালে প্রানঘাতী ব্লু হোয়েলের মতো অনেক অন লাইন গেম যা বয়ঃসন্ধির কিশোর কিশোরীদের আত্মঘাতী হতে বাধ্য করে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায়-
আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে হলে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। শিশুদের বিকাশের সময় এমনভাবে তাদের গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা সফলতার মতো ব্যর্থতাকেও মেনে নিতে পারে। আত্মহত্যার উপকরন যেমন-ঘুমের ওষুধ, কীটনাশক বিষ, দড়ি ইত্যাদির সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। কোনো মানসিক সমস্যার ইঙ্গিত পেলে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সবচেয়ে জোর দিতে হবে পারিবারিক বন্ধনের উপর। পরিবারের প্রত্যেকের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে সতর্কতা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। সুষ্ঠু ভাবে জীবনযাপন করার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পঠনপাঠনের সঙ্গে জীবনশৈলী সম্পর্কে পাঠ দান করতে হবে। সমস্যা দেখে না পালিয়ে তার মুখোমুখি হতে হবে। মনের মধ্যে কিছু চাপা না রেখে সকলের সাথে তা শেয়ার করা দরকার। জীবন যন্ত্রনা নয় বরং অনেক বেশি আনন্দের এই মনোভাব নিয়ে চলতে হবে। এককথায় জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধ যোগ্য বিষয়। সঠিক সময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে আত্মহত্যা ঠেকানো সম্ভব। তবে এর জন্য সবাইকে যার যার ক্ষেত্র থেকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।