চিন্তন নিউজ: ১৮ মে:– “অপরাজিত” দেখে ফিরে এসে এখনো ঘোরের মধ্যে রয়েছি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই বিশেষত আমাদের মত প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে যাওয়া বঙ্গভাষী চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আবেগকে পরিচালক স্পর্শ করেছেন সফলভাবে। “পথের পাঁচালি” ছবি তৈরির পিছনে সত্যজিৎ রায় নামে সদ্যস্বাধীন ভারতের এক শিক্ষিত স্বপ্নসন্ধানী যুবকের পরিশ্রম, নতুন কিছু করার এবং প্রথা ভাঙার সাহসী যাত্রাপথের বিবরণ ডকুফিচারের আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন আমাদের প্রত্যাশাকে কতকটা চ্যালেঞ্জ করেই। কেননা একুশ শতকে সাদাকালো ছবি কেন্দ্রীয় চরিত্রের বেতার সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে এমনটা অন্ততঃ বাংলা ছবির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালে দেখা যায় নি। সবাই জানি, অপরাজিত পূর্ণ অর্থে সত্যজিৎ রায়ের প্রামাণ্য জীবনীচিত্রের খণ্ডাংশ নয়, তা সত্ত্বেও প্রথম ছবি পথের পদাবলীর জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া চিত্রপরিচালক অপরাজিত রায়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত এক বাস্তবিক কিংবদন্তি চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ যাতে উল্লেখ থাকছে চিত্রগ্রাহক হিসাবে প্রথম কাজ করার সুযোগ পেয়েই সুবীর মিত্রের বাউন্স লাইটের প্রকৌশল খুঁজে নেওয়ার তথ্য,তখন ইতিহাসকে তুলে আনতে একনিষ্ঠ শিল্পগবেষক অনীক দত্তের প্রতি সম্ভ্রম জাগে বইকি।
এটা ঘটনা, সাদা কালো ছাড়া “অপরাজিত” নির্মাণ কল্পনাই করা যেত না এটা যেমন ঠিক,তেমনি অনীক দত্ত ছাড়া জিতু কমল কে দিয়ে অপরাজিত রায় চরিত্রে অভিনয় করানো থেকে একাধারে বিজ্ঞাপনের অফিসের দু নম্বর কর্তা ও প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধারের চরিত্রে সুমিত সমাদ্দার কে ব্যবহার করার কথা কেউ ভাবত বলে মনে হয় না।নিঃসন্দেহে বিজ্ঞাপন ও প্রচার বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণেই পরিচালক ডিটেলে মনোযোগ দিয়েও কাহিনীর গতিকে শ্লথ হতে দেন নি। অভিজিৎ রায় চরিত্রে চন্দ্রাশিস রায়ের কন্ঠ একটি বিশেষ মাত্রা সৃষ্টি করেছে। নানা কারণে মনে হয়েছে স্বপ্ন দৃশ্যটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং একইরকম তাৎপর্যপূর্ণ অফিসে জরুরি কাজে আটকে যাওয়া অপরাজিত রায়ের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর সহকারীদের আন্তরিকতার সঙ্গে বৃষ্টিতে মানিক ও উমার ভেজার দৃশ্য গ্রহণের দৃশ্যটি। দুই প্রধান অভিনেত্রী অনসূয়া মজুমদার এবং সায়নী ঘোষ যতখানি সাবলীল অঞ্জনা বসু এবং ছোট্ট চরিত্রে মানসী সিনহাও ততখানিই নজর কাড়েন। কস্টিউমে শুচিস্মিতা দাশগুপ্ত ও মেক আপ পরিকল্পনায় সোমনাথ কুন্ডুর ভূমিকা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়। চিত্রগ্রহণে সুপ্রতীক ভোল, সম্পাদনায় অর্ঘ্যকমল মিত্র এবং আবহসঙ্গীত পরিচালনায় দেবজ্যোতি মিশ্র অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন।
কেবল দুটি সমালোচনা থাকবে। একটি মুখ্যমন্ত্রী বিমান রায়ের চরিত্রটিকে প্রায় কমিক রিলিফের পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়ার জন্য অন্যটি এদেশের বামপন্থীদের সিনেমা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে অপরাজিত রায়ের মূল্যায়নের জন্য। যে সময় অপরাজিত রায় পথের পদাবলী করছেন তার প্রায় এক দশক আগে তো আইপিটিএ ধরতি কে লাল ছবিটি প্রযোজনা করেছিল – অপরাজিত রায়ের মত যুবক তার খবর রাখবেন না – ভাবা যায় না। এ বিষয়ে অপরাজিত রায়ের মন্তব্যটি খুবই সাধারণ মানের বলে মনে হয়েছে।
সবশেষে বলি অসাধ্য সাধন করেছেন অনীক দত্ত! এযাবৎ অনীকের সেরা ছবি অপরাজিত। বাস্তব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পুর্ননির্মানের চেয়ে এই ছবিকে অনেক বেশি মৌলিক সৃষ্টি মনে হয়েছে।
পথের পাঁচালি এখনো দেখতে বসলে চোখ ভিজে আসে, অপরাজিত দেখতে বসেও তেমনটাই হল! নির্বোধদের আবেগ ধরে রাখা এমনিই মুশকিল হয়,বয়স বাড়লে তো আরও সমস্যা!