কলমের খোঁচা

‘সত্যেন সেন; বাঙালির চেতনার অহঙ্কার’ – গৌতম রায়


চিন্তন নিউজ: ২৮শে মে:- বিজ্ঞান এবং উপন্যাসের জন্য পারস্পরিক অভিজ্ঞতার উপর সবথেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন ক্রিস্টোফারকডওয়েল। এই নির্দেশিকা যেন উনিশ শতকের নবজাগরণ স্নাত, বিশ শতকের উত্তোলনকালে পথিক সত্যেন সেনের (১৯০৭-১৯৮১) মধ্যে একটা চিরকালীন সত্য হিসেবে আমাদের সামনে উঠে এসেছিল।

ভারতীয় উপমহাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য আর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার অভিধারাতে , অভ্যুত্থানের পর অভ্যূত্থানের সংকল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে গত শতাব্দীর আটের দশকের সূচনা লগ্ন পর্যন্ত আমাদের চেতনার প্রতিটি তন্তু কে রসসিক্ত করে গিয়েছেন যাঁরা, সত্যেন সেন তাদের মধ্যে অন্যতম ।

মানব মুক্তির লক্ষ্যে একটার পর একটা দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে , এক অনন্য সাধারণ উদ্যোগে পুরুষ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে সত্যেন সেন যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন আজকের প্রজন্মের কাছে তা প্রায় অজানা। বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জের সত্যেন সেনের জন্ম। তাঁর গোটা জীবনের কর্মকাণ্ডের প্রায় সবটাই ব্যাপ্ত ছিল বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে। বহুধাবিভক্ত তাঁর কর্মকাণ্ড। একদিকে রাজনৈতিক অভিধা। অপরদিকে বাংলা ভাষায় ধ্রুপদী ধারার উপন্যাস এবং চরিত্রের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে যে এক অনবদ্য অবদান সত্যেন সেন রেখে গিয়েছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত বলতে হয় য, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।

বাংলাদেশের বৃহত্তর ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে এক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী পরিবারের সত্যেন সেন জন্মেছিলেন। পদ্মা, ধলেশ্বরীর বিপুল জলধারার এক রসসিক্ত ভূমি ছিল সত্যেন সেনের মানসলোক গঠনের প্রধান বিষয়। কৈশোর কাল থেকেই বিপ্লবী জীবনে যেন পরতের পর পরত তিনি অতিক্রম করে কখনো এগিয়েছেন ঝঞ্ঝার বেগে, কখনো এগিয়েছেন শান্ত ধীর পদক্ষেপে। এমন দীর্ঘ পথ চলার পর হাজার ১৯৮১ সালে ৭৪ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে নিজের দিদির বাড়িতে তাঁর জীবন দীপ নিভে যায়।

পদ্মা- ধলেশ্বরীর অববাহিকায় বেড়ে ওঠা মানুষটি একদম জীবন সায়াহ্নে , যখন তিনি দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন, শারীরিক শক্তি ও প্রায় নিঃশেষিত– এইরকম একটা সময়ে তারুণ্যের, যৌবনের দিনগুলিকে ছুটে গিয়েছিলেন কোপাই নদীকে আশ্রয় করে। অথচ কোপাই তখন জলহীন, শীর্ণ। কোপাইকে দেখে যেন সত্যেন সেন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, তাঁর জীবনের অস্তমিত সূর্যের আলোতে বাঙালি, বাঙালি মনীষার এক চরম ক্রান্তিকাল এই সময়কালের ছায়াতে সত্যেন সেনকে কাছ থেকে দেখবার সুযোগ যাঁরা পেয়েছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছিল , তাঁর মধ্যে কেন শেখ সাদির মত কবিতা লেখার জন্য দুটো জীবনকালের আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে।শেখ সাদি চেয়েছিলেন; একটা জীবন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য । আর একটা জীবন অভিজ্ঞতাকে কবিতার মানস প্রতিমা প্রাণদানের জন্যে।

৭৪ বছর বয়সে জীবনদীপ নির্বাপিত হওয়ার সময়কালে ,বিপ্লবতাপস সত্যেন সেন যেন তাঁর প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে , সাহিত্যে তাকে আবার নতুন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন। জাতীয় আন্দোলনের সশস্ত্র বিপ্লবী ধারায় সেই কোন ছোটবেলা সত্যেনের হাতেখড়ি। তিরিশের দশকের শুরু থেকেই তাঁর পলাতক জীবন সশস্ত্র ধারার জাতীয় আন্দোলনের স্বার্থে। এইসব একদিকে যেমন তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে পরিপূর্ণতা দিয়েছে , অপরদিকে তেমনি তাঁর বোধের আরোহীনীতে সমাজতন্ত্রের চেতনাকে একটা দৃঢ় সংবদ্ধ অভিধা রাতে প্রতিষ্ঠা করেছে।

দীর্ঘ সাত বছর জেল এবং অন্তরীণ জীবন তাঁকে দিয়েছে জীবন সম্বন্ধে এক বেদনাবিধুর অথচ আনন্দঘন অভিজ্ঞতা । এই সময়কালে কারাবাস থেকে মুক্তির পর, কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা , কমিউনিস্ট পার্টির একজন তুখোড় সংগঠক হিসেবে, কৃষক সমিতির ভেতর দিয়ে পূর্ববঙ্গের গ্রাম-গ্রামান্তরে জীবন-জীবিকার লড়াইকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি ।সমাজতন্ত্রের শেকড়কে মাটির একদম গভীরে পৌঁছে দেওয়ার যে তাগিদ –এমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা , বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষদের খুব কমই আছে ।

সত্যেন সেনের সহযোগী সোমেন চন্দের যে অভিজ্ঞতা ছিল কৃষক- শ্রমিক সমাজের মধ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে, একদম প্রত্যক্ষভাবে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করার ভেতর দিয়ে ,তেমন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গোপাল হালদার পরবর্তীকালে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিছুটা হলে ও সমরেশ বসু, জেলজীবন কালেই সত্যেন সেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জীবনকে সম্পৃক্ত করে ,মানব মুক্তির লক্ষ্যে নিজের জীবনকে পরিচালিত করার তাগিদে ,তিনি পারিবারিক দারিদ্র সত্ত্বেও শিক্ষকতার পেশাকে গ্রহণ করেননি। সে যুগে কৃষক সমিতির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে এভাবে রাজনৈতিক জীবন বেছে নেওয়ার ঘটনা কিন্তু খুব বেশি দেখতে পাওয়া যায় না।

হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণুদের মত মানুষজন , এঁরাও কিন্তু সেই সময় কখনই রাজনীতির সর্বক্ষণের কর্মী হননি ।শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এই দিক থেকে সত্যেন সেন, গোপাল হালদার , সোমেন চন্দ ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম । পারিবারিক সূত্র ধরেই রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে সত্যেন সেনের একটা অন্তরের সম্পর্ক ছিল । সেই সম্পর্কের জেরেই তিনের দশকের শেষ দিকে জেল জীবনের বেশ কিছুদিন পরে তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় শান্তিনিকেতন থেকে গবেষণার জন্য একটা বৃত্তি পর্যন্ত পেয়েছিলেন । পারিবারিক স্তরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যে ঐতিহ্য সত্যেন সেনের ছিল , তাকে তিনি পরিচালিত করেছিলেন নিজের জীবনে গণসংগীত রচনা ভেতর দিয়ে। সেই গণসংগীতকে তিনি পরিচালিত করেছিলেন ঢাকা জেলার কৃষকদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। এই সময়কালে কলকাতার কৃষক সমিতির বিভিন্ন সভা-সমিতিতে সত্যেন সেনের লেখা গণ সঙ্গীত পরিবেশিত হতো।

সোমেন চন্দের পাশবিক হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য কমরেড সত্যেন সেন শহীদ বন্ধুর বেওনেট তাঁর নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দেশভাগের পর ,তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে নিজেকে ব্যাপৃত করেন ।পূর্ব পাকিস্তানের তেভাগা আন্দোলনের যে ব্যাপ্তি, তাকে সাধারনভাবে আমরা রাজশাহী জেলার নাচোল অঞ্চলের কৃষক আন্দোলন এবং ইলা মিত্রের কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি ।ইলা মিত্রের উপর নাচোল থানায় পাকিস্তানি পুলিশের বর্বরোচিত আক্রমণ এবং ইলা মিত্রের আদালতে দেওয়া সেই ঐতিহাসিক জবানবন্দি – সেগুলি একটি আন্তর্জাতিক মাত্রা পেলেও ,গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনের একটা চরম পরিণতি হিসেবে তেভাগা কর্মকাণ্ডকে ব্যক্ত করার ভেতর দিয়ে, পশ্চিম পাকিস্তান যে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন মুসলিম জাতীয়তাবাদের চিন্তা ধারণাকে চাপিয়ে দিয়ে, বাঙালির ভেতরের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ কে তীব্র করে তুলতে চেষ্টা করেছিল , ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে জোরদার করে দেওয়ার একটা তাগিদ দেখাতে শুরু করে দিয়েছিল, সেই সমস্ত রকমের বদমাইশি বিরুদ্ধে সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ এবং সত্যেন সেন , কৃষক সভার ভেতর দিয়ে একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।

বস্তুত সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, সত্যেন সেন প্রমুখের নেতৃত্বে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক আন্দোলন ভূমি স্রে শিকড় বিস্তার করতে সক্ষম হয়।তার জেরে ই কিন্তু সেই দেশের মাটি মুসলিম জাতীয়তাবাদের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে অপসারিত করে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ নামক অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারার ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠাতার একটা প্রস্তুতকালীন পটভূমি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের তেভাগা আন্দোলনের যে কর্মকাণ্ড মনসুর হাবিবুল্লাহ এবং সত্যেন সেন ও তাঁদের সহযোগীরা তম মিলে ব্যপ্ত করতে পেরেছিলেন , সেই গোটা পটভূমিকাকে কিন্তু পূর্ব সেই দেশের প্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা-চেতনার সামাজিক ভিত্তিভূমির একটি অঙ্কুরোদগম হিসেবে দেখা দরকার।এই পরিস্থিতি নিজেকে যেভাবে মেলে ধরতে পেরেছিল , তাই পরবর্তীকালে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ,বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি রচনা করেছিল।
দেশভাগের অব্যবহিত পরে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্টদের নানাভাবে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে পশ্চিম পাকিস্তানে শাসকেরা।এই কাজে পূর্ব পাকিস্তান কে কেন্দ্র করে যে সমস্ত সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতো জাতীয় আন্দোলনের কালে, সেই সব কর্মকাণ্ডের সংগঠকদের খুব একটা যে নিরপেক্ষ ভূমিকা ছিল, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই ।অনুশীলন সমিতির সঙ্গে সংযুক্ত লোকেরা এই সময়কালে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার রাজনৈতিক পটভূমিকা অনুযায়ী , ক্রমশ নিজেদের ট্রটস্কি পন্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করে । তাঁরা কমিউনিষ্টদের প্রধান শত্রু হিসেবে ধরে নেয় ।এই কাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রথম জীবনের রাজনৈতিক সহকর্মীরাও বিশেষভাবে কমিউনিষ্টদের বিরুদ্ধে অস্ত্র শোনাতে শুরু করে।
এই সম্মিলিত শক্তিই কিন্তু সোমেন চন্দকে খুন করে।সেই সম্মিলিত শক্তি ই কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিকে পূর্ব পাকিস্তানের নানাভাবে অসুবিধার মধ্যে ফেলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের সঙ্গে একযোগে এই দ্বিমুখী আক্রমনকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লাহ এবং সত্যেন সেন , তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন ।

সোমেন চন্দ শহীদ হওয়ার পর তদানীন্তন পূর্ব পূর্ব পাকিস্তানে শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষিত বেশ ভালো রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়।ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ক্ষতি হয়।কমিউনিস্টরা যাতে কোনো অবস্থাতেই পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে, এইজন্য পূর্ব পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি চিন্তা ধারায় যে সমস্ত ব্যক্তিরা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল , তারা কমিউনিস্টদের উপরে নানা ধরনের পাশবিক রাষ্ট্রীয় অত্যাচার নামিয়ে আনে।

এই অত্যাচারের উদাহরণ হিসেবে আমরা রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি চালানো ঘটনার উল্লেখ করতে পারি।অপরদিকে এককালে যাঁরা সশস্ত্র বিপ্লবী চিন্তাধারার ভেতর দিয়ে ইংরেজকে এদেশ থেকে তাড়ানোর ধারণায় জীবনপণ করে লড়াই করেছিলেন, সেই সমস্ত মানুষদের একাংশের আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে যে কমিউনিস্টবিরোধী মানসিকতা তৈরি হয়েছিল ,তাকে খুব জোরদারভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা, পূর্বপাকিস্তানে কমিউনিস্টরা যাতে কোনভাবে শক্তিশালী হতে না পারে, তার জন্য ব্যবহার করেছিল ।এই লক্ষ্যে বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হয় পূর্বতন অনুশীলন সমিতির লোকজনেরা।এঁরাই পরবর্তীকালে ট্রটস্কি পন্থী হয়ে কমিউনিস্টবিরোধীতায় মেতে উঠেছিল। এঁরা পরবর্তীকালে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র পরিচালিত করার লক্ষ্যে আর এস পি নামক একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করে।

অপরপক্ষে ছিলেন সুভাষচন্দ্রের অনুগামীরা ।তবে এইসব সুভাষচন্দ্রের অনুগামীরা কিন্তু ছিলেন আইএনএ প্রতিষ্ঠার আগে সুভাষচন্দ্রের যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড , তার সঙ্গে সম্পৃক্ত।যেমন ছিলেন ফণিভূষণ মজুমদার।যিনি খুনি খোন্দকার মোশতাক মন্ত্রীসভার সদস্য ও ছিলেন। আইএনএ প্রতিষ্ঠার পর এই সমস্ত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সংযোগ প্রায় সম্পর্ক ই ছিল না বলা যেতে পারে।

এইরকম একটি সময়কালে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে ,কমিউনিস্টদের সংগঠিত করবার ক্ষেত্রে ‘৪৭ পরবর্তী সময়ে সত্যেন সেনের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন, গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে তেভাগা আন্দোলন , কৃষক আন্দোলন কে একটা সুসংবদ্ধ রূপ দিয়েছিল। এই সময়ে পূর্ব পাকিস্থানে সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ নেতৃত্বে একটা ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রম চলেছিল ।তেমনি ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে, সমাজতন্ত্রের চিন্তায় নিজের জীবনকে উৎসর্গীকৃত করে, কমিউনিস্ট পার্টিকে কেন্দ্র করে থাকা, কমিউনিস্ট কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজনদের সঙ্ঘবদ্ধ করা, গোপন সংগঠন পরিচালনা করা , আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ‘৪৭ পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন সত্যেন সেন।
এই সময়কালে আর এস পি , ফরওয়ার্ড ব্লক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের ত্রিমুখী আক্রমণে কমিউনিষ্টদের একটা ভয়ঙ্কর রকমের কোনঠাসা অবস্থা ছিল ।সদ্য গঠিত পূর্বপাকিস্তানে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেনের কর্মকাণ্ড, সেটি অবশ্য তিনি খুব বেশিদিন চালাতে সক্ষম হননি। কারণ ,’৪৯ সালে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান।’৫৩ সালে মুক্তিলাভ করেন এবং থেকে যান ঢাকা পূর্বপাকিস্তানে ই।
১৯৫৩- ৫৪ সালে অবিভক্ত পাকিস্থানের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে যে রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি হয় , সেটাকে কাজে লাগিয়ে সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে আবার কমিউনিস্টদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড শুরু হয় ।তবে পাকিস্তানের শাসকেরা আধা সামরিক শাসন জারি করে । যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভাকে অপসারিত করে এবং মুক্তবুদ্ধির পক্ষের সমস্ত ধরনের মানুষজনদের উপরে নামিয়ে আনে অত্যাচারের স্টিমরোলার ।
এই সময় আবার জেলে যেতে হয় সত্যেন সেনকে।’৫৫ সালে জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিন বছর ‘সংবাদ’ এ তিনি সহকারি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন ।সংবাদ পত্রিকায় শহিদুল্লাহ কায়সারের মত মানুষজনদের সহকর্মী হিসেবে সত্যেন সেন পেয়েছিলেন ।এই সময়কালে তেভাগা আন্দোলন এবং হাজং আন্দোলনের উৎস সন্ধানে পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে যে ধরনের ক্ষেত্রসমীক্ষা সত্যেন সেন করেছিলেন, তাকে এককথায় আন্তর্জাতিক স্তরের ক্ষেত্রসমীক্ষা বলে উল্লেখ করতে হয়।
সেইসব ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং ব্যক্তিগত নানা অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি রচনা করেছিলেন,’ গ্রাম বাংলার পথে পথে ‘ নামক এক ঐতিহাসিক গ্রন্থ । পূর্ব পাকিস্তানের গোটা বাঙালি সমাজের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে সত্যেন সেনের লেখা ‘গ্রাম বাংলার পথে পথে’ গ্রন্থখানি একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখের দাবি রাখে। কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি , মেহনতি জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি- এই দাবির মূল লক্ষ্য ছিল; সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ।এই দাবি পরিচালনার লক্ষ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতাকে সমূলে উৎপাটন করে, একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা ,যা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পরিচালিত হবে– সত্যেন সেনের এই গ্রন্থটি জনতার অভিষ্পার একটি জ্বলন্ত স্বাক্ষর ।
এই সময়কালে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ কে কেন্দ্র করে’ মহা বিদ্রোহের কাহিনী ‘ নামক সত্যেন সেন যে গ্রন্থটি রচনা করেন সেটি ও বাংলা ভাষায় লেখা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অত্যন্ত মূল্যবান দলিল।
গণ আন্দোলনকে সাহিত্যের অঙ্গনে একটি ধ্রুপদী ধারা তে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যের দুটি নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে ।একটি হলেন শহিদুল্লাহ কায়সার। আরেকটি হলেন সত্যেন সেন ।শহীদুল্লাহ কায়সার জেলে বসে ‘সংশপ্তক ‘ নামক যে অসামান্য গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। গণআন্দোলনকে প্রেক্ষিত হিসেবে উপস্থাপিত করে , এমন ধ্রুপদী অঙ্গের সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে হয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ আছে।
‘ গণদেবতা’ ইত্যাদি উপন্যাসের ভেতর দিয়ে গণ আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠা করার একটা চেষ্টা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন ঠিকই । গণআন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে শহীদুল্লা কায়সার , সোমেন চন্দ, সত্যেন সেনদের মতো কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তারাশংকরের কিন্তু ছিলনা ।
তাই শহীদুল্লা কায়সারের সৃষ্টি বা সত্যেন সেনের সৃষ্টিকে পাশাপাশি রেখে যদি তুলনামূলক আলোচনা করা যায়, তারাশঙ্করের উপন্যাস গুলি র , তাহলে খুব সহজেই দেখতে পাওয়া যাবে , গণআন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে শহীদুল্লাহ কায়সার বা সত্যেন সেনের সৃষ্টির পূর্ণতা , আর তারাশঙ্করের সৃষ্টির অপূর্ণতা এবং খামতির দিকগুলি।
আমাদের দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী সাহিত্য-সমালোচকেরা পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশের সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যকে বা সেই সব সাহিত্যের স্রষ্টা রা যখন জন্মসূত্রে মুসলমান হন ,তাঁদের ক্ষেত্রে কাগজ কলমের আঁচড় ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্পণ্য দেখিয়ে থাকেন। তাই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন শ্রমিক-কৃষক মেহনতি জনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সোমেন চন্দ , সত্যেন সেন, শহীদুল্লাহ কায়সার বা তাঁর ভাই জহির রায়হান যে সমস্ত অমূল্য সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যে রেখে গিয়েছেন , সেইসব সম্পর্কে এপারের বাঙালিদের সচেতন করার কোন চেষ্টাই পন্ডিত মহল করেন নি।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।